এখন জাতীয় ঐক্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে হবে এই ঐক্য—এ প্রশ্নের কিনারাও কঠিন নয়। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফায় ক্ষমতায় গেলে আন্দোলনের সব শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ওয়াদা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকভাবে ফাংশন করছে না, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে হাজারো মানুষের রক্তস্নাত অভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত সরকার জনসমর্থন হারাবে, সরকার ব্যর্থ হলে অন্য কোনো পক্ষ সুযোগ নিতে পারে—এসব উপলব্ধিও প্রায় সব দলের। মানে উপলব্ধিগত ঐক্যও হয়ে আছে। এখন এটাকে জাতীয় রূপ দেওয়ার বিষয়
আবারও জোর আলোচনায় জাতীয় ঐক্য। প্রধান উপদেষ্টা একটি জাতীয় ঐক্যের জন্য মাথা পানি করে ফেলছেন টানা প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে। তার সঙ্গে যখন যে দলের নেতারা দেখা করছেন তাদেরই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান করছেন তিনি। প্রবীণ নেতা সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম একজন ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্য-জাতীয় ঐক্য করছেন গত কয়েক যুগ ধরে। জেএসডি-জাসদ সভাপতি আ স ম রব জাতীয় ঐক্যের কথা বলতে বলতে ক্লান্ত। এখন প্রধান উপদেষ্টার কাছে বড় দল বিএনপির আকাঙ্ক্ষা-তাগিদ-আবদার-দাবিও জাতীয় ঐক্য। তাদের এ দাবিতে ঘটা করে একাত্মতা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
প্রশ্ন আসছে জাতীয় ঐক্য জিনিসটা কী? তা দেখতে কেমন? সব দল ঐক্যবদ্ধ হওয়া বা সব দল এক হয়ে যাওয়া মানেই জাতীয় ঐক্য? জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য পার্টি, জাতীয় ঐক্য ফোরাম ধরনের নাম দিয়ে কতগুলো দল তো আছেই বাংলাদেশে। এসব নামাবলি অনেকটাই বায়বীয়। জাতীয় ঐক্য ধরা বা ছোঁয়ার জিনিস নয়। বিষয়টি আসলে উপলব্ধিগত। যে উপলব্ধির উদাহরণ এবারের জুলাই-আগস্ট বিপ্লব। আর ঘটনা ৫ আগস্ট। মোটাদাগের একটি ঐক্যের ফলই ৫ আগস্ট। একমাত্র তখনকার ক্ষমতাসীন ও তাদের সহযোগী-সুবিধাভোগী কিছু দল এবং মহল ছাড়া বাদবাকি সবাই ছিলেন ঐক্যভুক্ত। ধীরে ধীরে ওই ঐক্যে গোলমাল। সেইসঙ্গে অবিশ্বাস-সন্দেহ।
এই সুযোগে ভর করেছে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি। এ বাস্তবতায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে বিএনপি। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বিএনপি উদ্বেগ থেকেই ঐক্যের কথা বলছে। দলটির শঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অভ্যুত্থানের বৃহত্তম শরিক হিসেবে দায় নিতে হবে। নৈরাজ্য চললে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তৃতীয় পক্ষ এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কিছুটা সংগঠিত হতে শুরু করায়, তারা এতে সমর্থন দেবে। আবার ছাত্র নেতৃত্ব যেভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মুখোমুখি করছে, তাও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছে দলটি। প্রধান উপদেষ্টা এতে একমত হয়েছেন। সন্তুষ্টও হয়েছেন। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু অপপ্রচার হচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপির পক্ষ থেকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির স্ট্যাবিলিটি নিশ্চিতে সবার মধ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির তাগিদ দিয়েছেন। বিশেষ করে ছাত্র, জনতা, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টানসহ সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন। চট্টগ্রামের ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত গত কয়েক দিনের সংঘটিত ঘটনাবলি এবং দেশজুড়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা চেয়েছে। আর ব্যবস্থা বলতে একটি ঐক্য। শাসন বা আরোপ করে এই ঐক্যের বন্দোবস্ত হয় না। নিজেদের সুবিধামতো কিছু মানুষ একত্রিত হওয়া মানেও ঐক্য নয়। কারও স্বঃপ্রণোদিত নৈতিক সচেতনতা থেকেই জন্ম হয় জাতীয় ঐক্যের। নৈতিক সচেতনতা গড়ে ওঠে রাষ্ট্র ব্যবস্থার ওপর। নৈতিক বোধ ছাড়া আপনাআপনিই একটি মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি গড়ে উঠতে পারে না। নৈতিকবোধ আমদানি করাও যায় না।
ঘটনার পরম্পরা ও অনিবার্যতায় এবার সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের সেই অর্জনের স্থায়িত্ব দিতে জাতীয় ঐক্যই এখন একমাত্র দাওয়াই। তা সম্ভব জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিভেদ ভোলানোর মাধ্যমে। নোবেলজয়ী, বিশ্বমানের ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূসের মধ্যস্থতায়, রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধিগত ঐক্যের মাধ্যমে এর একটি সম্ভাবনা বিরাজমান। দেশের সর্বজনীন স্বার্থে এবং সংকটে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে একত্রিত হয়ে দেশের উন্নতির জন্য এবং দেশরক্ষার জন্য কাজ করা জাতীয় ঐক্যের বিষয়। দেশের এ নাজুক সময়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভক্তি, রাজনৈতিক সংকট এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে একটি বোঝাপড়ায় তা সম্ভব। এমন সুযোগ বারবার আসে না। ৫ আগস্ট সেই সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। জাতীয় ঐক্যের জন্য জাতীয় প্রয়োজন খুব প্রাসঙ্গিক। ঐতিহাসিক, সমাজতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতা এখানে ফ্যাক্টর।
এর আগে একাত্তরে সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। নব্বইতেও জাতীয় ঐক্যের একটা সুযোগ তৈরি হয়েও হয়নি। বিশেষত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার লড়াই ঐক্য বিনষ্ট করেছে। এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে জাতীয় ঐক্যের যে বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, তা খুব কম জাতির সামনেই আসে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের মতামত সম্মানিত হবে। এর ফলে জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা বাড়বে এবং জাতীয় ঐক্য মজবুত হবে।
রাজনৈতিক বিভক্তি চিরতরে কেটে যাবে না। তা কমবেশি সবসময় থাকবে। তবে নেতৃত্ব যদি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিলে, দলীয় বিভেদ জাতীয় ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। দেশের সংকটময় সময়ে রাজনৈতিক নেতারা দলীয় বিভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থে এক হয়ে কাজ করলে, তা জনগণের মধ্যে ঐক্যের বার্তা দেবে। জাতীয় ঐক্যই হলো যে কোনো দেশের উন্নয়নের মূল ভিত্তি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভেদ, বৈষম্য এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থকে পেছনে ফেলে জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত না করে পারে না।
এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বৈপ্লবিক মাহাত্ম্য, জাতীয় ঐক্যকে বাস্তব করার সমূহ সম্ভাবনা আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে। এতে সাড়া দেওয়া, না দেওয়ার ওপর নির্ভর করছে আগামীর বাংলাদেশ। বিভেদ, বৈষম্য ও সংকীর্ণ স্বার্থের কারণে আমরা বারবার জাতি হিসেবে নানানভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছি। বিশেষত দেশ কীভাবে চলবে সেই বন্দোবস্ত হয়নি। জাতীয় ঐক্যকে রাখা হয়েছে উপেক্ষিত করে। বরং একে অন্যকে উৎখাত করে নিজের ক্ষমতা পোক্ত করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এবারের সুযোগটি যেন হাতছাড়া না হয়, এজন্য দরকার সুদৃঢ় ও দূরদর্শিতাপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব। উন্নত, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য আমাদের মৌলিক বিষয় ও অগ্রাধিকারগুলো আগে ঠিক করা দরকার। কাউকে না কাউকে এবং কোনো না কোনো এক সময়ে জাতির বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে রাজনীতির নোংরামিতে ফুলস্টপ দিতে হবে।
কাকে দিয়ে, কাকে নিয়ে এ জাতীয় ঐক্যের গোড়া পত্তন হবে; তা এরই মধ্যে পরিষ্কার। গত কয়েক দিনের নৈরাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলো যে জাতীয় তাড়নায় ভুগছে, একে ভিত্তি ধরে এগোলে দিশা না মেলে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব, সর্বোপরি জনগণ সবাই এ তাড়নায় আক্রান্ত। নির্বাচন, কূটনৈতিক সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে তাদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ প্রকাশ্যে পেলেও ঐক্যের পথে তা বাধা হবে না। নানামুখী চাপ মোকাবিলা ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষার সুবাদে একটা পথের দিশা মিলবেই। অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে অস্বস্তি অনেকের। যখন-তখন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন এবং বিশৃঙ্খলায় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ অনিরাপদ বোধ করছেন। ধর্মীয় ইস্যু এবং হুটহাট দাবিতে কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে।
কে না বোঝে শৃঙ্খলা না ফিরলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। এ উপলব্ধিতে তো একটা জাতীয় ঐক্য হয়েই আছে। রাজনৈতিক দলগুলো চলমান অস্থিরতার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে। ষড়যন্ত্রের আতঙ্কে ভুগছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অন্তর্বর্তী সরকারের শক্তির পাটাতন রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন। সেই সমর্থন নিশ্চিত করতে তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে। ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে দৌড়ঝাঁপ না দিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টির যে কোনো প্রয়াস ঠেকাতে হবে। ঝাড়ফুঁক বা মেডিসিনে তা আর সম্ভব নয়, তা পরিষ্কার। তা করতে হবে শক্তভাবে। এ বোধেরও একটা ঐক্য হয়ে গেছে। আর কী লাগে!
এখন জাতীয় ঐক্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে হবে এই ঐক্য—এ প্রশ্নের কিনারাও কঠিন নয়। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফায় ক্ষমতায় গেলে আন্দোলনের সব শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের ওয়াদা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ঠিকভাবে ফাংশন করছে না, এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে হাজারো মানুষের রক্তস্নাত অভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত সরকার জনসমর্থন হারাবে, সরকার ব্যর্থ হলে অন্য কোনো পক্ষ সুযোগ নিতে পারে—এসব উপলব্ধিও প্রায় সব দলের। মানে উপলব্ধিগত ঐক্যও হয়ে আছে। এখন এটাকে জাতীয় রূপ দেওয়ার বিষয়। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর উপলব্ধিগত এই ‘এনগেজমেন্ট’ বাড়ানোর মুরুব্বির কেদারায় তাদের সবার কম পছন্দের ড. ইউনূস তো আছেনই। তার উপদেষ্টারাও জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। তাহলে আর বাকি থাকল কে? জাতীয় ঐক্য রচনা হলে ক্ষতির শিকার হওয়া শক্তি তা চাইবে না, সেটা তো স্বাভাবিকই।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন