২০২৩ সালে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে কমিয়ে আনা হলো ২ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে দেখানো হয়েছে ৮ শতাংশ। গোটা বিশ্বে যখন মূল্যস্ফীতি কমছে, তখন বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে বাড়ছে বা বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক জানা যায়, গত মার্চ মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। উল্লেখ্য, মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে। তবে কোনো লাভ হয়নি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। মাথাপিছু গড় ঋণ ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ঋণগ্রস্ত পরিবার হিসেবে এ অঙ্ক আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে শহরের মানুষকে বেশি ঋণ করতে হচ্ছে। ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে; বিবিএস খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। গত বছর ২৮ ডিসেম্বর বিবিএস এ তথ্য প্রকাশ করে। খানা আয় ও ব্যয় জরিপে সারা দেশের ১৪ হাজার ৪০০ পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালে জাতীয়ভাবে প্রতিটি পরিবারের গড় ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। গড়ে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪.২৬ ধরে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৬৬ টাকা। ২০১৬ সালের একই জরিপে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ২৪৩ টাকা। মাথাপিছু ঋণ ছিল ৯ হাজার ১৭৩ টাকা। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে প্রতিটি পরিবারের ঋণ বেড়েছে ১১১.১০ শতাংশ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড়ে ঋণজাতীয় পরিবারের ঋণের প্রায় আড়াইগুণ। ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৮ টাকা। এসব পরিবারের মানুষের গড়ে মাথাপিছু ঋণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৯৬৯ টাকা।
এদিকে গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলোর ঋণ প্রায় ২১০ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে গ্রাম এলাকায় পরিবারপ্রতি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ৪১১ টাকা, যেখানে শহরের পরিবারগুলোর ঋণ গড়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৪৫৬ টাকা, যা গ্রামের তুলনায় প্রায় তিনগুণের বেশি। যদিও শহরের ঋণগ্রস্ত পরিবারের গড় ঋণ ৪ লাখ ১২ হাজার ৬৩৮ টাকা। ছয় বছরের ব্যবধানে শহরে বাস করা পরিবারগুলোর ঋণগ্রস্ত হওয়ার হার বেড়েছে ১৩০.১০ শতাংশ। গ্রামের পরিবারগুলোর ঋণ বেড়েছে ৪১.৭৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে গ্রামে পরিবারপ্রতি ঋণ ছিল ৩১ হাজার ৩৩২ টাকা, শহরে ছিল ৫৯ হাজার ৭২৮ টাকা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেড়েছে আয়বৈষম্যও। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অধিকাংশ পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে। অনেক পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহরের দরিদ্র মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বেশি।
‘করোনা মহামারি ও পরবর্তী প্রতিবন্ধকতা কীভাবে বাংলাদেশের দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য, শিক্ষা এবং খাদ্য সুরক্ষার ওপর প্রভাব ফেলছে’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) ও যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে। এতে বলা হয়, ২০১৮ সালে শহরাঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে গ্রামীণ দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে।
সানেম-জিইডি গত ২০১৮ সালে দেশব্যাপী ১০ হাজার ৫০০টি খানায় একটি জরিপ চালায়। এর মধ্যে ৯ হাজার ৬৫টি খানায় গত বছর অক্টোবর ও নভেম্বরে আবার জরিপ করা হয়। সেই জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা গবেষণা প্রতিবেদনের ফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়। তাদের গবেষণায় বলা হয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ৭০ শতাংশ খানা বা পরিবার তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে। পাশাপাশি ৩৫ শতাংশ পরিবার খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কাটছাঁট করেছে। ২৮ শতাংশ ঋণ নিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ সঞ্চয় কমিয়েছে। পরিবারগুলোর ব্যয় বাড়লেও একটি বড় অংশের আয় বাড়েনি অথবা কমেছে। এর ফলে অতিদরিদ্র খানার (পরিবার) সদস্যদের মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২০১৮ সালের তুলনায় গত বছর ২০ শতাংশ কমেছে। শহরের দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। গ্রামের ২৯ শতাংশ ও শহরের ৩২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার মাঝারিভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। শহরের দরিদ্ররা গ্রামের তুলনায় বেশি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। গ্রামের ২৯ শতাংশ ও শহরের ৩২ শতাংশ দরিদ্র পরিবার মাঝারিভাবে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) নির্দেশিকা অনুযায়ী, এ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা পরিমাপ করা হয়েছে। এটি ছিল ২০১৮ সালের প্রতিবেদন।
মূল্যস্ফীতিতে ৭০ শতাংশ পরিবারের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন—এ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ পরিবার মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছে, ৩৫ শতাংশ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় হ্রাস করেছে, ২৮ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছে এবং ১৭ শতাংশ সঞ্চয় হ্রাস করেছে। খাদ্যাভ্যাসের এমন হ্রাসমান তারতম্য পরিবারগুলোকে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে ফেলেছে। দরিদ্র পরিবারের মধ্যে, মাঝারি খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে ৫ শতাংশ পয়েন্ট (এপ্রিল ২০২৩-এ ২৫ শতাংশ থেকে অক্টোবর-নভেম্বর ২০২৩-এ ৩০ শতাংশ), যেখানে গুরুতর খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ৩ শতাংশ পয়েন্ট বেড়েছে (৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে)।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী পণ্যের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দেয়। তবে মাস কয়েকের পর স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করে। প্রায় এক বছর ধরে গোটা বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যসহ যাবতীয় জিনিসপত্রের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তবে বাংলাদেশে দফায় দফায় দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। বাংলাদেশ যেসব ভোগ্যপণ্য আমদানি করে থাকে বা করছে, তা প্রতিটির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। আমদানি করা পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারদর ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সোজা কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারদর কমছে, বাংলাদেশে বাড়ছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর কারণ কতটুকু যৌক্তিক?
লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন