পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো যন্ত্রের নাম বোধহয় ‘স্বরযন্ত্র’। কেননা প্রাণীমাত্রই জন্মসূত্রে এই যন্ত্র পেয়ে থাকে। তার মধ্য়ে প্রাণিকুলের শ্রেষ্ঠ মানব প্রজাতি যন্ত্রটির সর্বোচ্চ ব্য়বহার করে থাকে। সুন্দর ললিতকলা—আবৃত্তি, সংগীত, নাটক, প্রার্থনা থেকে শুরু করে নৃশংস, কর্কশ ব্য়বহারেও সমান পারঙ্গম তারা। স্বরযন্ত্র মানে কণ্ঠনালি বা কথা বলার যন্ত্র অর্থাৎ গলা। এর অতি ব্য়বহারকে গলাবাজিও বলা হয়। তবে ষড়যন্ত্রে যথেচ্ছার ব্য়বহার বেড়েছে স্বরযন্ত্রের। হালকা চালে শুরু করলেও বিষয়টি অত পলকা নায়। পৃথিবী সৃষ্টির আগে থেকেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া গেছে। প্রতিটি ধর্ম এবং লোককাহিনিতে এর প্রমাণ মেলে। দেবতারাও এর বাইরে নয়। দুনিয়ার তাবৎ মহাপুরুষ ষড়যন্ত্রের শিকার। আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ এর চর্চা করে মানুষের বিরুদ্ধে। এখন আর দেবতা বা শয়তানের দরকার হয় না। আর বিষয়টির ব্য়াপক জনপ্রিয়তা দেখা যায় রাজনীতিতে। একসময় রাজনৈতিক মাঠে ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ কথাটির খুব প্রচলন ছিল। এখন সবকিছুই নিচের দিকে দ্রুত ধাবমান। তাই ষড়যন্ত্রও পৌঁছে গেছে বস্তি পর্যন্ত।
ফৌজদারি আইন অনুযায়ী, ‘ষড়যন্ত্র হচ্ছে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির ভবিষ্যতে কোনো অপরাধসম্পন্ন করার জন্য একজোট হওয়া।’ আর রাজনীতিতে দেখা যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো একে অন্যের কার্যক্রমকে ষড়যন্ত্র বলে দোষারোপ করে। দলীয়-নির্দলীয় সব সরকারই মনে করে, বিরোধী মতের লোকজন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ সুযোগে আটকের পর চিহ্নিত অপরাধীও নিজেকে ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দাবি করে থাকেন। তার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা থাকলে তো কথাই নেই। বহুল আলোচিত ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ অনুযায়ী মার্কিন সরকার বা বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ঘটনা বা বিপর্যয়কে নিজস্ব সুবিধা লাভের জন্য পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এ তত্ত্বের মধ্যে একটি ধারণা আছে যে, সরকার বা প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের অজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ সাধন করে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারে সোচ্চার নাগরিকরা তত্ত্বটি বিশ্বাস করেন। পৃথিবীজুড়ে এ মার্কিন নীতি কাজ করছে বলে প্রচারণা আছে। এর শিকার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। বাংলাদেশও এর ব্য়তিক্রম নয়।
বছরের পর বছর লোকদেখানো নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্য়মে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিল ফ্য়াসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার। প্রকাশ্য়ে প্রতিবেশী বিরাট রাষ্ট্রের অন্য়ায় আবদার পূরণ করেছেন দিনের পর দিন পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে কথা সদম্ভে জনসমক্ষে বলেছেনও তিনি। বিনিময়ে ভায়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৃপা লাভ করেছে হাসিনা সরকার। অথচ, বিরোধীমতের আন্দোলনকারীদের ষড়যন্ত্রকারী বলে বিষোদ্গার করেছেন সবসময়। মার্কিন প্রশাসনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য় করেও প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে সেলফি তুলে প্রচার করেছেন। এ দ্বিচারিতা দেখে বাংলাদেশের জনগণ লজ্জা পেলেও আওয়ামী লীগ হেঁটেছে রাজপথের মাঝখান দিয়ে। দেশের মানুষকে ভুলে বিদেশের কুকুরকে ঠাকুর ভেবেছে তারা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, সেই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অশালীন সমালোচনা করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন পুতুল বলে অভিযোগ করছে। বিদেশিদের হাতে দেশ তুলে দেওয়ার অভিযোগ করছেন প্রবাসে আশ্রিতা শেখ হাসিনা। সাধারণ মানুষ মনে করছে, তিনি যন্তর-মন্তরের পরামর্শে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন দিনে-রাতে।
ষড়যন্ত্র ব্য়াপারটার মধ্য়ে এক ধরনের নিষিদ্ধ আকর্ষণ আছে। চাওয়া-পাওয়ার দোলাচল, আলোছায়ার খেলায় রহস্য় কাজ করে। যে কারণে নভোচারী হয়েও চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং বলেছেন, ‘মানুষ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ভালোবাসে।’ ব্য়ক্তিগতভাবে কোনো লাভ নেই জেনেও তারা ইতিউতি করে। ঝুঁকি থাকার পরও এখানে-সেখানে কান পাতে। যদি কিছু জানা যায়। কোথায় কী ষড়যন্ত্র হচ্ছে! সারাদিনই একে অন্যকে চক্রান্তকারী বলে গালি দিচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ অত্য়ধিক রাজনীতিপ্রিয়। টং দোকানে চায়ের সঙ্গে টিভি দেখা ফ্রি। ইদানীং সিনেমা-নাটকে মন নেই। আবারও খবর-টক শোতে আগ্রহ তৈরি হয়েছে জনগণের। শেখ হাসিনা জীবদ্দশায় ক্ষমতা ছাড়বে না বলে প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিল হতাশ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী জনগণের বুকে গুলি চালাতে রাজি হয়নি। আবার তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বুকে আশ্রয় পেয়েছে পলাতক সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি-আমলারা। তাদের মধ্য় থেকে পঞ্চাশের অধিক অপরাধী হাট-মাঠ-ঘাট থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে। তাহলে বাকি প্রায় চারশ ভিআইপি কোথায় গেল? তাদের পলায়নে সহযোগিতার অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের কি বিচারের আওতায় আনা যাবে! অথবা, গণহত্য়ার নির্দেশকারী শেখ হাসিনাকে নিরাপদে কারা পৌঁছে দিল? তাদের দায়বোধ দেশ, আইন, জনগণ নাকি অন্য় কারও কাছে। এদিকে, সংস্কার আর নির্বাচন নিয়ে উঠেছে ষড়যন্ত্রের নতুন নতুন অভিযোগ, সন্দেহ।
গত ১৯ নভেম্বর রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত এক কর্মশালায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘দেশে কোথাও একটা ষড়যন্ত্র চলছে। জনগণকে বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।’ গত শনিবার চুয়াডাঙ্গা টাউন ফুটবল মাঠে জেলা বিএনপির সম্মেলনে তারেক রহমান বলেন, ‘দেশের নির্বাচন যতই দেরিতে হবে, ততই ষড়যন্ত্র বৃদ্ধি পাবে। জনগণের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার বিরুদ্ধে দেশের লক্ষকোটি মানুষ এক যুগের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছে, সেই স্বৈরাচার কিন্তু বসে নেই। তাদের দেশি-বিদেশি প্রভুদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে।’ এদিকে, সম্প্রতি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, তারা কখনো ‘ভারতবিরোধী ছিল না। এটি অপপ্রচার’। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করতে সুচিন্তিতভাবে মিথ্যা ও অপপ্রচার করা হয়েছে।’ কারও সঙ্গে বৈরিতা না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বই দলটির আন্তর্জাতিক নীতি। সম্প্রতি টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। আবার আওয়ামী লীগের ভারতপ্রীতির সমালোচনাও করে থাকে জামায়াত। তবে, দ্রুত নির্বাচন না হলে ষড়যন্ত্র বাড়বে—তারেক রহমানের এ বক্তব্য়ও সমর্থন করে দলটি।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য়ে ভোট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের দাবিতে ঐকমত্য় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। সেই অনুযায়ী সরকারকে বারবার তাগাদাও দিচ্ছে তারা। এদিকে, দেড় দশকের জমে থাকা শত শত দাবিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামছে প্রতিদিন। দাবির শহর ঢাকা দিন দিন নৈরাজ্য়ের দিকে যাচ্ছে। অনির্বাচিত সরকারের উদারতার সুযোগ নিচ্ছে নানা মহল। পতিত আওয়ামী লীগ বিভিন্ন নামে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্র করছে বলে মনে করে সরকার সমর্থকরা। সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেয় তারা। আবার, আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধী ইসলামপন্থি কিছু রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনও রাজপথে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। তাদের পেছনে উন্নত দেশের পৃষ্ঠপোষকতার ষড়যন্ত্র থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। রুশদের তাড়াতে আফগানিস্তানে একসময় ওসামা বিন লাদেনকে সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। পরে জঙ্গি, সন্ত্রাসী হিসেবে তাদের হাতেই মারা পড়েছে লাদেন। এসব খেলার মাজেজা জেহাদি জোশে হারিয়ে ফেলে অনেক ধার্মিক মানুষ। যাই হোক, নিপীড়ক আওয়ামী লীগের মতো দমননীতিতে যেতে চায় না বলে মনে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। যৌক্তিক সময়ের মধ্য়ে নির্বাচন দিতে এরই মধ্য়ে ইসি গঠন করেছে তারা। কিন্তু তা আবার প্রত্যাখ্যান করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার মধ্য দিয়ে গড়া ওঠা সংগঠনটি আরও সংস্কার চায়। সংস্কারের এ দীর্ঘসূত্রতা কেউ কেউ আবার অনিশ্চয়তার ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করে।
তবে ষড়যন্ত্র সবসময় খারাপ নয়। এ থেকে অনেক সময় ভালো কিছু হয়। সফলতা পেলে হয়, আলোচনা ফলপ্রসূ। ব্যর্থ হলে ‘ষড়যন্ত্র’। যেমন—‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। পূর্ব পাকিস্তান আমলে করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এ মামলায় অভিযোগ করা হয়, শেখ মুজিব ও অন্য ৩৫ জন ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল। নিষ্পত্তির চার যুগ পর ওই মামলার আসামি ক্যাপ্টেন এম. শওকত আলী (প্রয়াত ডেপুটি স্পিকার) ২০১১ সালে প্রকাশিত তার লেখা এক বইয়ে মামলাটিকে ‘সত্য মামলা’ বলে দাবি করেন। এখন ভারতে বসে বঙ্গবন্ধুকন্য়া শেখ হাসিনা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন বলে মনে করে বর্তমান সরকার ও বিক্ষুব্ধ জনতা। তবে দুটো পরিস্থিতি এক নয়। পুরো বিপরীত। গণঅভ্য়ুত্থানে জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে পালিয়েছেন তিনি। আর তার বাবা দেশকে মুক্ত করতে ভারতে বসে ষড়যন্ত্র করেছিলেন। সব মিলিয়ে ভয়ংকর হলেও রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ষড়যন্ত্র এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিশ্বকবি ও বহুদর্শী ব্য়ক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন—‘ষড়যন্ত্র বুঝতে শেখো, ষড়যন্ত্র করতে নয়।’ নিষ্কণ্টক ভবিষ্য়তের জন্য় উক্তিটি দায়িত্বশীলদের মর্মে ভক্তিভরে ধারণ করা জরুরি।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, কালবেলা