মাত্র দুটি অক্ষর দিয়ে লেখার মতো ছোট্ট একখানা নাম আছে আমার—অটো। নামে ছোট কিংবা দেখতে ছোট হলেও আমি যে সমাজে গোনায় ধরার মতো এক প্রজাতি, তা আশা করি এরই মধ্যে টের পেয়েছ। এতদিন তোমরা ‘শোনার টাইম নাই বলে’ আমাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছ। আমরা কতজন এই রাজধানী বা সারা দেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি, তা জানার জন্য আদমশুমারির মতো ‘অটো শুমারি’ করার প্রয়োজনও মনে করো নাই। তাই তোমাদের ঘুম ভাঙাতে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীনের ২০ দিনের মাথায় আমরা শাহবাগ দখল করে আমাদের শত্রুদের বিষদাঁত ভাঙতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল বিমানবন্দর দখল করে এবং পাখা লাগিয়ে মানুষের ছাদে ছাদে যাত্রী ওঠানামার ব্যবস্থা করব। এতে নিমিষেই তোমাদের শতবছরের যানজট হাওয়া করে দিতাম। আরও ইচ্ছা ছিল কমলাপুর রেলস্টেশন দখল করে এবং চাকাগুলো বদল করে আন্তঃজেলা অটো সার্ভিস চালু করব। সদরঘাট দখল করে নদীতেও অটো চালানোর এন্তেজাম করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমাদের সৎভাই প্যাডেল চালানো রিকশাগুলার জ্বালায় এ-যাত্রা সুবিধা করতে পারলাম না। তবে সবাইকে ঠিকই জানায় দিছি—‘কেউ আর আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।’
অনেক তো চেষ্টা করেছ আগে। ঝকঝক ও বকবক মন্ত্রণালয়ের খেতাবপ্রাপ্ত পলাতক মন্ত্রীরা ঘোষণার পর ঘোষণা দিয়েছে। সতর্ক করেছে। আইন-আদালত নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু আমার চাকার একটা শিকও তোমরা ছিঁড়তে পারো নাই। কারণ আমার দোয়া আর আশীর্বাদে কত পুলিশ, কত মাস্তান, কত চাঁদা আদায়কারী, কত ব্যাটারি চার্জওয়ালা আর কত বিদ্যুৎ বিভাগের কত লাইনম্যানের ভাগ্য খুলেছে, তা তোমরা জেনেও না জানার ভাব করো। আমাকে যারা চালায়, সেই অটোচালকরা হয়তো দুই মুঠ ভাত খেয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু আমার অসিলায় কাচ্চি খাওয়াদের সংখ্যা কিন্তু অনেক। তাই আগেও কিচ্ছু হয় নাই, ভবিষ্যতেও কি-স-সু হবে না। তাই বলি কি, আমারে আর খামোখা হাঁকডাক আর হাইকোর্ট দেখাবা না। এতে একশ্রেণির মানুষের চাঁদার রেট বাড়বে। কোট-কাচারি সামলানোর নামে চাঁদার অঙ্কে আরও কিছু টাকা যোগ হবে। কিন্তু বাস্তবে কিচ্ছু হবে না।
হবে কীভাবে বলো, এ দেশে অটো আমদানি বৈধ, ব্যাটারি আমদানি বৈধ, অটো বানাতে যা যা লাগে তার চৌদ্দগুষ্ঠি আমদানি বৈধ, খোলা অবস্থায় বিভিন্ন অংশ এনে জোড়া দিয়ে অটো বানানো বৈধ, অটোর ব্যাটারি আমদানি ও চার্জ দেওয়াও বৈধ। অবৈধ শুধু রাস্তায় অটো চলা। এ কেমন বিচার? ফেললা তো আবার মুশকিলে! বিচারের কথা উঠলেই বিশেষ অঙ্গফাটা কলাপাতা মানিকের কথা মনে পড়ে। থাক, এদিকে না গিয়ে মানিকগঞ্জের দিকে যাই। অটোর ব্যাটারি চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগে। মানিকগঞ্জের বিখ্যাত মানুষ বিদ্যুৎ ফেরিওয়ালা মমতাজ আপা। তারই জন্মভিটায় আরেক মমতাজ ছিলেন। শুদ্ধনাম গীতিকার মোমতাজ আলী খান। জব্বর কয়খানা গান লিখছিলেন এই প্রচারবিমুখ মানুষটা। আর দরদি গলায় সেই গান গেয়ে মানুষের মাথা অটোর চাকার মতো ঘুরিয়ে দিছিলেন মরমি গায়ক আবদুল আলীম। গানের ভাষায় আছে—‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো, সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো।’ মোমতাজ আর আবদুল আলীমের মানিকজোড়া বাইচা থাকলে অটোতে হাওয়া খেতে খেতে নির্ঘাত সুর তুলত—‘তুমি ইমপোর্টার হইয়া ইমপোর্ট করো, মহাজন হইয়া বেচো, পুলিশ হইয়া অটো ধরো, টাকা দিলে ছাড়ো।’
আমার কল্যাণে উপকারভোগীদের তালিকায় আরও অনেকেই আছে। যেমন মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা চা দোকানি। অটোতে একটা চক্কর দিয়েই মোড়ে বসে চা-পান-সিগারেটে সুখ টান দিতে যে কী মজা, তা কেবল একজন অটোচালকই বোঝে। কিন্তু এমন সুখ টানের কারণে যম যখন মৃত্যুর দিকে টানে, তখন আবার মজা লোটে ডাক্তার আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বাংলার প্রচলিত গানে আছে—‘শালুক ফুলের লাজ নাই, রাইতে শালুক ফোটে লো রাইতে শালুক ফোটে।’ এখন গ্রামেগঞ্জে যেভাবে কোন হাসপাতালে কোন ডাক্তার সপ্তাহের কোন কোন দিন বসেন এবং তাদের আগে-পরে দুর্বোধ্য ডিগ্রি আছে, তা অটোতে মাইক লাগিয়ে প্রচার করেন, তা শুনে মনে হতেই পারে—‘ডাক্তারেরও লাজ নাই, শুধু রোগী ডাকে লো, শুধুই রোগী ডাকে।’ ডাক্তারের চেম্বার আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী বাড়ার অন্যতম কারণও নাকি আমি অটো। আমার কারণে নাকি মানুষ পরিশ্রম ও ঘাম ঝরানো ভুলে যাচ্ছে আর শুয়েবসে রোগ বাধাচ্ছে। আমাদের কারণে ওষুধ কোম্পানিরও নাকি পোয়াবারো? এটা কোনো কথা হলো?
তবে সবাইকে সাবধান করে দিয়ে বলি, আমার পেছনে কেবল অটোযাত্রীরাই বসে না। আমার পেছনে কিন্তু আমদানিকারক, বাজারজাতকারী, ব্যবসায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদনের নেপথ্যে থাকা মাফিয়া শক্তি, বিদ্যুৎ বিভাগের সরকারি লোক, মোড়ের পুলিশ, স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজ, চা-পান-সিগারেট উৎপাদক ও বিপণন চক্র; এমনকি ডাক্তার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারও আছে। মানবাধিকার ও পরিবেশকর্মীর বেশে এরা সবাই আমাকে রক্ষায় এগিয়ে আসবে। অতএব অটো নিয়ে চটো কেন? ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব অটো।
আমাদের প্রেরণা আমাদেরই পূর্ববর্তী প্রজন্ম নছিমন, করিমন, ভটভটি, কটকটি, ভ্যান, মফিজ পরিবহন, এমন জানা-অজানা বহু ভাই-ব্রাদার আর মুরুব্বি একরামও আছেন আমাদের সঙ্গে। হাইকোর্টের বারান্দায় ব্যারিস্টার বেহুদারা ওনাগো নিয়ে হুদাই চিল্লায় কয়দিন পরপর। তারা কেবল বকবক করেছে আর রাস্তায় বীরদর্পে চলছে আমাদের শ্রদ্ধেয় দাদা ভটভটি আর নানি নছিমন। কিছুই করবার পারো নাই।
প্রতিবন্ধীরা আবার আমার গায়ে ‘আমি প্রতিবন্ধী’ কিংবা ‘প্রতিবন্ধীর গাড়ি’ লিখে আমাকে চালায়। পৃথিবীর বুকে যে কোনো গাড়ি চালানোর আগে চালকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বিশেষত চোখে ঠিকমতো দেখে কি না এবং রং চিনতে পারে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। কেবল এ দেশের প্রতিবন্ধীরা কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ না থাকলেও বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই শুধু নিজেই অটো চালায় না, চার-পাঁচটা জ্যান্ত মানুষ নিয়ে অটো চালায়। যে প্রতিবন্ধী নিজেই ঠিকমতো চলতে পারে না, সে দায়িত্ব নেয় আরও চার-পাঁচজনকে নিরাপদে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছে দেওয়ার। এ কৃতিত্ব তোমরা কেউ আমাদের দেও না। দেবে কেমন করে? যারা এসব কৃতিত্ব আমাদের দেওয়ার কথা তারা নিজেরাই তো এক-একটা প্রতিবন্ধী। ১৬ বছর ধরে তারা কেউ বাকপ্রতিবন্ধী, কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউ আবার বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ছিল। তা না হলে আমরা অটো সমাজের এত ভাইবোন কেন। দেখো না আমাদের একেকজনের কী বিচিত্র চেহারা? কেউ একজন টানলে অন্যরা দুজন টানে, কেউবা আবার আটজনও টানে। কেউ ঘোমটা দিয়ে চলি, কেউ আবার ঘোমটা ছাড়া। কারও ইট-সিমেন্ট টানার জন্য তক্তা বিছানো শক্ত শরীর, কেউ আবার নরম তুলতুলে গদি চড়িয়েছে গায়ের ওপর। ভোটের সময় আমার কদর আবার সবার ওপর। এত সস্তায় শোডাউনের এমন মাধ্যম আর কে দেবে?
আমরা শুধু যাত্রীই টানি না। পৌর এলাকার ময়লা, শিল্প এলাকার গ্যাসের সিলিন্ডার, গ্রাম্য এলাকার বিশাল বিশাল ধানের বস্তার স্তূপ, বন্য এলাকার বিশাল গাছের গুঁড়ি বা কাণ্ড, বাঁশবাগানের বাঁশের বহর, বালুমহালের বালু, ইটভাটার ইট, এমনকি অক্সিজেন ও স্যালাইন লাগানো হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীও টানি।
সুতরাং হে রাজধানীবাসী, জেনে রাখো, ‘আমি হ্যামিলনের সেই অটোওয়ালা, ছড়াব টাকা ঘাটে ঘাটে, আমাকে মানতেই হবে, যেখানেই বসো, যত ওপরে।’
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর; গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট