ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দেওয়ার দাবিতে শিক্ষার্থীরা কলেজের সামনের রাস্তা গত ১৮ নভেম্বর বন্ধ করে দেয় এবং তেজগাঁওয়ে ট্রেন থামানোর চেষ্টা করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে শিশু ও নারীসহ বহু মানুষকে আহত করেছে। একটি সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা নিয়ে নিচের প্রশ্নগুলো করা যেতে পারে। (ক) তিতুমীর কলেজকে কেন বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে হবে, বাংলাদেশে কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক কম? (খ) আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশকে কী দিচ্ছে? (গ) আমাদের কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর না করাই কি শিক্ষার বড় সমস্যা? (ঘ) কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর সঙ্গে সাধারণ মানুষের, রিকশা, বাসযাত্রী ও ট্রেনের যাত্রীদের হেনস্তা করা, রক্তাক্ত করার মধ্যে কী সম্পর্ক রয়েছে? (ঙ) একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা বা দেশে কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে সেই সিদ্ধান্ত কি শিক্ষার্থীরা নেবে নাকি পলিসি মেকাররা নেবে? (চ) কিছু শিক্ষার্থী এ ধরনের দাবি করতেই পারেন কিন্তু দাবি আদায়ের পথ কি ওই একটাই, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা আর কষ্ট দেওয়া?
দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বা পারসেপশন কী? ধরুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকা কলেজ! এর আশপাশের যত দোকানদার, ফুটপাত থেকে স্বর্ণের দোকান—সব ধরনের দোকান থেকেই একদল শিক্ষার্থী নিয়মিত চাঁদা তোলে। কথায় কথায় দোকানদার, পথচারী, বাস, রিকশা সব ধরনের যানবাহনের ক্ষতি করা, চালকদের পান থেকে চুন খসলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা, যানবাহন ভেঙে ফেলা, রিকশাওয়ালাদের ভাড়া না দেওয়া—সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষার্থীদের এ পরিচয়। তারা বরং চান তাদের আশপাশে এ জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকুক। সচেতন ও শিক্ষিত সমাজের কাছে আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী বা এগুলো মূল্যায়ন কী? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমার উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক ধরনের বেকার ও কর্মবিমুখ জনগোষ্ঠী তৈরির কারখানা। অশিক্ষিত বেকার একটা কিছু করে খেতে পারেন কিন্তু শিক্ষিত বেকারদের অবস্থা ভয়ানক! তারা নিজেরা কোনো কাজ করবেন না; কারণ, এক-দুটি সার্টিফিকেট আছে। তারা বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন তথা সমাজের ওপর বোঝা হয়ে থাকেন বছরের পর বছর। সাধারণ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্ররাজনীতি, পেশিশক্তির মহড়া আর শিক্ষক রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে কী ধরনের শিক্ষার্থী উৎপাদন করছে, তা পুরো জাতি জানে। সেখানে এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মিলে দুইশর কাছাকাছি। আরও নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তথা সার্টিফিকেট বিক্রির দোকান অনুমোদন পাচ্ছে। আর জেলায় জেলায় উর্বর জমি নষ্ট করে নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির মহাপরিকল্পনায় মত্ত ছিল পূর্ববর্তী পতিত সরকার। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাই পাল্টে দিয়েছিল। একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি বিশাল গবেষণাগার, জ্ঞানের আধার, যেখানে বিচরণ করবেন দেশের প্রকৃত জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিরা। তারা দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো নেতা তৈরি করবে, বিজ্ঞানী তৈরি করবে। অথচ পতিত সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের সব ধরনের দুষ্কর্মের পকেট হিসেবে, তাদের পেটোয়া বাহিনী এবং লাঠিয়াল বাহিনী তৈরির কারখানা এবং আজ্ঞাবহ কিছু শিক্ষকের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য এ পরিকল্পনা করেছিল। দেশ এসব অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কীভাবে এসবের সমাধান করা যায়। তার মধ্যে আবার কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে এবং সেজন্য মানুষকে শাস্তি ও কষ্ট দিতে হবে। এ কেমনতর খেলা!
আমাদের বিশেষায়িত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালে কী দেখতে পাই? প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা আমাদের মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সবারই আশা থাকে তারা দেশকে অনেক কিছু দেবে আর তাই দরিদ্র জনগণের করের টাকায় সরকার অনেক অর্থ ব্যয় করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আর কৃষিবিদ তৈরির জন্য। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কী পাই? যে কোনো রোগের জন্য যাদের একটু সামর্থ্য আছে তারা আর রোগ একটু জটিল হলে সহায়-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসার জন্য সবাই ভারতের ডাক্তারদের কাছে দৌড়ান। দেশি ডাক্তারদের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। আর যাদের টাকা-পয়সা একটু বেশি তারা হয় থাইল্যান্ড না হয় সিঙ্গাপুরে যান চিকিৎসার জন্য। তাহলে এত অর্থ ব্যয় করে ডাক্তার বানানোর কী দরকার?
আমরা অনেক প্রকৌশল তৈরি করছি কিন্তু দেশের ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার বানানোর জন্য চীন অথবা জাপানের প্রকৌশলীদের সাহায্য নিতে হয়। দেশের ইঞ্জিনিয়াররা তাদের অর্জিত জ্ঞান জলাঞ্জলি দিয়ে তারা সরকারি ক্লার্ক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। একইভাবে কৃষিপ্রধান দেশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কৃষিবিদদের অনেক অবদান রাখার কথা অথচ তারা হচ্ছেন ব্যাংকার না হয় পুলিশ। এ হচ্ছে বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থা। আর সাধারণগুলোতে বেকার তৈরির প্রতিষ্ঠান ছাড়া তেমন কিছু নয়। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তকমা দিয়ে জাতির কী উপকার হবে? শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবেই-বা কী উপকার হবে? অভিভাবকরা কি অতিরিক্ত কোনো সুবিধা পাবেন?
দেশে সরকারি চাকরির সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত! সেটি যে হারে গ্র্যাজুয়েট বেরোচ্ছে তার কাছে নস্যি মাত্র। চাকরি করতে হবে হয় বেসরকারি কোনো উদ্যোক্তার প্রতিষ্ঠানে কিংবা বিদেশি বা আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হলে তো প্র্যাকটিকাল কিছু স্কিল অর্জন করতে হয়। আমাদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেগুলোর ধারেকাছেও নেই। কিছু থিওরি পড়ানো ছাড়া, তাও হয়তো কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন নিজ বিষয় সম্পর্কে ভালোভাবে কিছু বলতে পারেন। ফলে যেটি হচ্ছে কাজের জন্য আমাদের দেশের ও বিদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে কর্মী ও কর্মকর্তা নিয়ে আসছে, কারণ তাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা রয়েছে। আর আমরা প্রোডাকশন দিচ্ছি বেকারের! এই বাস্তবতায় একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে জনস্বার্থবিরোধী কাজ এ দেশের শিক্ষার্থীরা আর কতদিন করবে? তাদের তো দেশের প্রতি একটি দায়িত্ববোধ রয়েছে। দায়িত্ব পালন নাই করল কিন্তু মানুষকে এভাবে নিজেদের স্বার্থের জন্য কিংবা যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই কতকাল কষ্ট দেবে?
একটি সিটিতে জনসংখ্যা ও যানবাহন অনুযায়ী ২৫ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়, সেখানে ঢাকায় আছে ৭ শতাংশ। অর্থাৎ, এমনিতেই সাধারণ অবস্থায় যানবাহনের জট লেগে থাকবে এবং আছেও। প্রতিদিন মানুষের লাখ লাখ কর্মঘণ্টা এমনিতেই নষ্ট হচ্ছে। সেখানে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানোর জন্য সেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়া কীসের স্বার্থে? কাদের স্বার্থে? কাদের প্ররোচনায়? শিক্ষাক্ষেত্রেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বহু কিছু করণীয় আছে। আসল জায়গাগুলোতেই তারা এখনো হাত দিতে পারেনি, সম্ভবও নয়। সেখানে তাদের অতিরিক্ত চিন্তায় ফেলে দেওয়া অর্থাৎ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানানো তো এ সরকারের কাজ নয়। যেসব শিক্ষার্থী এ বিষয়গুলো না বোঝে তারা কীসের শিক্ষার্থী? কীসের গ্র্যাজুয়েট? শিক্ষিত মানে তো একটি সার্টিফিকেট নয়, শিক্ষিত মানে হচ্ছে দেশ, জাতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন থাকা, অবগত হওয়া।
দেশের সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করে রাষ্ট্রযন্ত্র, পুলিশ, বিভিন্ন বাহিনী, রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, দ্রব্যমূল্য আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অথচ তারা যে বিষয়েই পড়াশোনা করুক না কেন, তাদের মূল শিক্ষা হবে দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, দেশকে ব্যক্তিপর্যায় থেকে সামষ্টিকভাবে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। আর তাই দেশের মানুষকে শিক্ষিত হতে হবে এবং সমাজ ও রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালন করবে। আর আমরা দেখতে পাচ্ছি সমাজ ও রাষ্ট্র শিক্ষার্থীদের লালন করছে সমাজ ও মানুষদের উৎপীড়ন করার জন্য। আর কতকাল এ খেলা চলবে?
শিক্ষার্থীদের যদি কোনো কারণে আন্দোলন করতেই হয়, সেটি হতে হবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, অত্যন্ত যুক্তিসংগত। তারা কোনো বিষয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে পারে, জনগণের মতামত নিতে পারে। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার চালাতে পারে কেন তারা কোনো একটি বিষয় চাচ্ছে। তারপর সড়কের পাশে, প্রেস ক্লাবের সামনে তাদের দাবির কথা জানাতে পারে। পরে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যেতে পারে। এভাবে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে কিন্তু কোনোভাবেই তাদের দাবিদাওয়া আদায় যাতে সাধারণ মানুষে কষ্টের কারণ না হয়। কারণ, মানুষ এমনিতেই বিভিন্ন ধরনের উৎপীড়নের মধ্যে আছে। তার মধ্যে আবার শিক্ষার্থীদের উৎপীড়ন!
এ দেশের সাধারণ মানুষ কি সারা জীবনই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাবে? রাস্তায় নামলে গন্তব্যে পৌঁছা তাদের অনিশ্চিত, তাদের জীবন হুমকির মুখে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জীবনে নাভিশ্বাস উঠিয়ে ফেলছে। তার মধ্যে তাদের যে কোনো ধরনের উটকো ঝামেলায় ফেলার অধিকার কারোরই নেই। আমাদের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যত তাড়াতাড়ি বিষয়গুলো বুঝবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক