আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি)-এর ২৭তম প্রতিষ্ঠা দিবস । যদিও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২৬ বছর খুব দীর্ঘকাল নয়, দেশে বশেমুরকৃবি এরই মধ্যে একটি অনন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই স্বল্প সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি কৃষিতে নতুন জ্ঞান-সৃজন, সৃজিত জ্ঞানের আলোকে উদ্ভাসিত আগামী দিনের নেতৃত্ব তৈরি এবং সর্বোপরি গবেষণালব্ধ নতুন জ্ঞানের প্রয়োগে কৃষিকে ‘স্মার্ট কৃষি’তে রূপান্তরে দেশে এক অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে। টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং সিস্টেমে বশেমুরকৃবি এ বছর দেশের শ্রেষ্ঠতম বিশ্ববিদ্যালয়। দুই হাজারের কম ছাত্রছাত্রীর একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়িয়ে দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান অর্জন করেছে, এটি নিশ্চয়ই অনেকের কাছে একটি কৌতূহলী প্রশ্ন! এমতাবস্থায়, বশেমুরকৃবির জন্মদিনে দেশের উচ্চশিক্ষায় এর ঈর্ষণীয় অর্জন এবং এটিকে বিশ্বমানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করাই এ প্রবন্ধের অবতারণা। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি এ বছর ২৬ বছর বয়স অতিক্রম করছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যাপনা এবং রোমাঞ্চকর গবেষণার অভিজ্ঞতা ১৪ বছরের কিছুটা বেশি মাত্র।
বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বশেমুরকৃবির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর। এটি পূর্বতন ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচারের (ইপসা) উন্নীতকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ-জাপান-যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ত্রিপক্ষীয় আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় ১৯৯১ সাল থেকে দেশে উচ্চতর কৃষি শিক্ষায় স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইপসা এ দেশে সর্বপ্রথম ট্রাইমিস্টার (সামার, অটাম ও উইন্টার টার্ম) নর্থ-আমেরিকান কোর্স ক্রেডিট শিক্ষাদান পদ্ধতির প্রবর্তন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির পাশাপাশি ২০০৫ সাল থেকে চার বছর মেয়াদি বিএস (কৃষি), ২০০৯ সাল থেকে বিএস (ফিশারিজ) এবং ২০১০ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন, ২০১২ সাল থেকে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ উন্নয়ন এবং ২০২২ সাল থেকে বিএস (ফরেস্ট্রি) ডিগ্রির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৯ সাল থেকে ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) চালু করে জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিষয়ে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রি এবং পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনিং প্রদান করা হচ্ছে। আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় কৃষককে আগাম ও সঠিক তথ্য প্রদান বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরির লক্ষ্যে অ্যাগ্রোমেটেরিওলজি বিভাগ চালু করা হয়েছে। জলবায়ুবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণা জোরদার করার জন্য ইনস্টিটিউট অব ক্লাইমেন্ট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামে পৃথক একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি দেশের মানুষের নিরাপদ খাদ্য ও উৎপাদিত খাদ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের উন্নয়ন ও বহুমুখী ব্যবহারসহ যুগোপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য ইনস্টিটিউট অব ফুড সেফটি অ্যান্ড প্রসেসিং নামে আরও একটি নতুন ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। সম্প্রতি ফেকাল্টি অব এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড বায়োরিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএস প্রোগ্রামে প্রথমবার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। ফলে বশেমুরকৃবির শিক্ষা প্রোগ্রাম যুগোপযোগী ও বৈচিত্র্যময় এবং গবেষণা প্রয়োজনভিত্তিক ও অগ্রসরমাণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমের পাশাপাশি বশেমুরকৃবিতে বহিরাঙ্গন কার্যক্রম একটি অন্যতম কর্মকাণ্ড, যা ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা বহিরাঙ্গন কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। ল্যাবরেটরি ও মাঠভিত্তিক গবেষণার পাশাপাশি বহিরাঙ্গন কার্যক্রম কৃষক ও গবেষকদের মধ্যে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবিত গবেষণালব্ধ ফল কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে গবেষণা কর্মশালা, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের মাধ্যমে অবহিত করানো হয়। বহিরাঙ্গন কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার জন্য গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার টোকনগরী এবং সদর উপজেলার কাউলতিয়ায় দুটি ‘প্রযুক্তি ভিলেজ’ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতালের মাধ্যমে প্রান্তিক চাষি ও খামারিদের হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর নিয়মিত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে পশুপাখি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে, তা নিরূপণ এবং টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বশেমুরকৃবিতে আধুনিক গবেষণা স্থাপনা এবং সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
গত ২৬ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিকারভাবেই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে এবং ক্রমেই একটি গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। বশেমুরকৃবিতে বিশেষ করে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রী, পোস্টডক্টরাল ফেলো এবং তরুণ শিক্ষকদের গবেষণায় মনোযোগ খুবই লক্ষণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি এ বছরই প্রথম টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিংয়ে দেশে শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা অর্জন করেছে।
সবশেষে বশেমুরকৃবির ২৭তম জন্মোৎসবে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব শুভানুধ্যায়ীদের অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। জ্ঞান-সৃজন, সংরক্ষণ, বিতরণের মাধ্যমে বশেমুরকৃবি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হোক। আগামী বছরগুলোতে এই অনন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বে কৃষিশিক্ষা ও গবেষণায় একটি অনন্য উৎকর্ষতার কেন্দ্রে উন্নীত হোক।
লেখক: ফেলো, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি
ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়