স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির খেল দেখিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ পুঁজি-লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনার পরিবার। আর ছিল এস আলম, সালমান এফ রহমানের মতো লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলা
সাড়ে পনেরো বছর ধরে গেড়ে বসা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাণভয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় অর্জন করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড থেকে কোনো শিক্ষা হয়নি তার। ২০১০ সালে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের সুবিধা নিয়ে ২০১১ সালে হাসিনা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করেছিলেন, যার ফলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি একতরফা নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে সাড়ে দশ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা জবরদখলে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। ২০১১ সাল থেকেই সব প্রধান বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া তিনটি একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি। বরং, ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে সাড়ে দশ বছর দেশের জনগণের মনে ধারণা গেড়ে বসেছিল যে, হাসিনার জীবদ্দশায় এ দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে আর সরকার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। জনগণের হতাশা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু হাসিনা নিজের অবৈধ ক্ষমতাকে এসব নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী করায় ক্রমেই জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ক্রমবর্ধমান ক্রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে চলেছিল যে, সুযোগ পেলেই তারা একটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করে সরকারকে উৎখাত করে ছাড়বে। সে সুযোগ এনে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্রছাত্রীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম। এই তিনটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ বরবাদ করে দিয়ে শেখ হাসিনাই গণঅভ্যুত্থানে সরকার উৎখাতকে ডেকে এনেছেন। গত ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় যখন পলায়নকারী শেখ হাসিনার উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে উড়াল দেয়, তখন ঢাকার উপকণ্ঠ থেকে লাখ লাখ মানুষের মিছিল রাজপথ ধরে শাহবাগ, গণভবন ও সংসদ ভবনের দিকে ধাবিত হয়।
হাসিনা তার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলে নিকৃষ্টতম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ মাধ্যমে তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্ক-ব্যবসায়ী এবং পুঁজি-লুটেরাদের সঙ্গে নিয়ে যে লাখ লাখ কোটি টাকা লুণ্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তার ভয়াবহ কাহিনি তার পতনের পর উদঘাটিত হতে শুরু করেছে। খবরে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, সাড়ে পনেরো বছরে দেশের জনগণকে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা ঋণের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। এর মানে এই দুই ঋণের স্থিতির অঙ্কের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে ওপরে উল্লিখিত ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এ সুবিশাল ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপির উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে এককথায় বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সঙ্গে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রতিজন বাংলাদেশির মাথার ওপর এক লাখ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে।
স্বৈরাচারী সরকার সাড়ে পনেরো বছর ধরে উচ্চ মাথাপিছু জিডিপি প্রবৃদ্ধির খেল দেখিয়ে দেশটাকে লুটেপুটে ছারখার করে দিয়েছে, যে অর্থের সিংহভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এ পুঁজি-লুণ্ঠনের কেন্দ্রে ছিল হাসিনার পরিবার। আর ছিল এস আলম, সালমান এফ রহমানের মতো লুটেরা অলিগার্ক ব্যবসায়ী এবং হাজার হাজার লুটেরা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজ আমলা। শুধু একজন এস আলম নাকি ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকের মালিকানা জবরদখলের মাধ্যমে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। সালমান এফ রহমান তার বেক্সিমকো গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে লুটে নিয়েছে ৩৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। প্রতিটি মেগা-প্রকল্প ও দেশের শত শত প্রকল্প থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে এই সাড়ে পনেরো বছরে। উপরন্তু, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে প্রচণ্ড লুটপাটের শিকার করে রেখেছিল হাসিনার সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের প্রদত্ত তথ্য মোতাবেক, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পৌনে ১৭ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের মধ্যে কমপক্ষে ৬ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে, যার অধিকাংশই দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। রাঘববোয়াল ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের’ ট্রাইব্যুনালের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে হাসিনা সরকার ছিল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি দাবি করেছে যে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত তিন বছরে ২৭.৫ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও হাসিনার টনক নড়েনি।
গত ৮ আগস্ট প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সোয়া তিন মাস ধরে প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিকে ‘মেল্টডাউন’ থেকে বাঁচানোর জন্য। এস আলম কর্তৃক লুটে নেওয়া সাতটি ব্যাংকসহ এগারোটি ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে দেউলিয়া হওয়া থেকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কয়েকটি ব্যাংককে তারল্য সরবরাহ করা হয়েছে ওগুলোকে আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রয় বন্ধ করা হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতন থামিয়ে দেওয়ার জন্য। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবি থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে রিজার্ভকে কিছুটা চাঙা করার জন্য। মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্দেশ্যে অনেক পণ্য আমদানিতে শুল্কহ্রাস করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম টাকার অঙ্কে ১২০-এ স্থিতিশীল রাখার প্রয়াস জোরদার করা হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা নিরসনের উদ্দেশ্যে। আমদানি বাণিজ্যের ওভারইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং কঠোর ও জোরদার করা হয়েছে। অবশ্য, খুশির খবর হলো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিন মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে ডলারের সরবরাহ অনেকখানি বেড়ে যাওয়ায় কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের পার্থক্য সরকার-নির্ধারিত বাজারের দামের ১ শতাংশের মধ্যে এসে গেছে এবং স্থিতিশীল রয়েছে।
ওপরের তথ্য-উপাত্ত থেকে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে দেশের ফাইন্যান্সিয়াল খাতের মারাত্মক সংকট কাটিয়ে ওঠা যাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি টিমকে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর একটি শ্বেতপত্র রচনার দায়িত্ব অর্পণ করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে সরকার অর্থনীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পেয়ে যাবে। উপরন্তু, প্রফেসর ইউনূস ১০ জন বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞের নেতৃত্বে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন এবং সুপারিশ-প্রণয়ন সম্পন্ন করবেন বলে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর ওই সুপারিশগুলো নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চূড়ান্তভাবে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু করবে। ওই প্রক্রিয়ার পর দেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ঘোষণা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস।
ওপরের বর্ণনা থেকে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পারফরম্যান্সে জনগণ খুশি।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও
অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়