অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ এএম
আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শান্তি চাই শান্তি নামুক

শান্তি চাই শান্তি নামুক

মানুষে মানুষে হানাহানি আর শিকারের প্রবণতা পুরোনো। আমরা তার খপ্পরে পড়ি বারবার। দিনশেষে সে একই মানুষ। সে পরিচিত জনপদ আস্তানা মানুষের প্রিয় মুখ। সে কারণেই আজ শান্তির দরকার সবচেয়ে অধিক। আপনি দেশ ও দেশের বাইরের যে কোনো বাঙালিকে প্রশ্ন করে দেখুন, সবাই বলবে আমরা আর কিছু চাই না, শুধু শান্তি চাই

আমাদের জীবনে সবচেয়ে মিসিং বিষয়টা হচ্ছে শান্তি। সত্যি কথা বলতে কি, গত কয়েক মাস ধরে ভালো থাকার আশায় পথ চাওয়া মানুষজন এখন শান্তির জন্য মরিয়া। ভাবছেন দেশের কথা বলছি। জি না। দুনিয়ার সব দেশের বাংলাদেশিদের চাওয়া এখন শান্তি। একটা কথা মানতেই হবে, মানুষের পরম চাওয়া শান্তিপূর্ণ জীবন। তাকে উত্তেজিত করে রাখার ভেতরে ব্যক্তিসমষ্টি বা রাজনীতির স্বার্থ থাকতে পারে, জনগণের কিছু থাকে না।

দেশের জনগণ যা চান, তা দিতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। দুনিয়ার কোনো দেশ বা সমাজ তা পারেনি। আমরা আমেরিকাকে এক নম্বর দেশ বলে জানি। বহু দেশের মেধাবী মানুষরা সে দেশে গিয়ে তাদের মেধা আর শ্রমে আমেরিকা নির্মাণ করেছেন। কিন্তু আমেরিকায় দারিদ্র্য আর দরিদ্র দেখলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। কোনোভাবেই বলা যাবে না সে দেশে সবাই ভালো আছে। চীন এখন পরাশক্তি। সে দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর ও দারিদ্র্যের প্রকোপ আছে। এমন করে আমরা সব দেশেই দরিদ্র মানুষ পাব, পাব অভাব-অনটন। কিন্তু কথা ওই একটাই। যখন বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না তখন আমরা যে শান্তি আর সহমর্মিতা দেখেছি, তা কি আজ আছে?

মিডিয়ায় চোখ রাখলেই মব জাস্টিসের কাহিনি। গোড়ার দিকে এসব মেনে নেওয়া গেলেও এখন কি আসলেই তা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না? যারা আমাদের শান্তি দেবেন বা দিতে পারেন, তারা জানেন কোথায় গলদ। কোথায় শান্তির চাবিকাঠি। তারা যত তাড়াতাড়ি তা বের করে আনবেন, তত মানুষ স্বস্তি লাভ করবে। এ বিষয়ে মিডিয়ার ভূমিকাও জোরালো হওয়ার দরকার।

জনসাধারণের ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে মিডিয়ার রয়েছে গভীর প্রভাব। শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, সহযোগিতা এবং সমাধানের ওপর জোর দেয় এমন ইতিবাচক বর্ণনাকে সক্রিয়ভাবে প্রচার করার মাধ্যমে, মিডিয়া শান্তির সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখতে পারে। অধিকন্তু, শ্রোতাদের ওপর মিডিয়ার প্রভাব বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি মিডিয়া প্রযোজকদের তাদের বিষয়বস্তুকে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যগুলোর সঙ্গে সারিবদ্ধ করতে সক্ষম করতে পারে।

মিডিয়া জনসাধারণের ধারণাকে প্রভাবিত করে এমন একটি উপায় হলো দ্বন্দ্ব ও সংকটের চিত্রায়ণের মাধ্যমে। যখন সংঘাতগুলো একটি উত্তেজনাপূর্ণ এবং হিংসাত্মকভাবে চিত্রিত করা হয়, তখন এটি জনসাধারণের মধ্যে ভয় ও বিদ্বেষ বাড়াতে পারে। যাই হোক, যখন মিডিয়া স্থিতিস্থাপকতা, সহানুভূতি ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের গল্পগুলোতে ফোকাস করতে বেছে নেয়, তখন এটি আশাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে এবং ব্যক্তিদের শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপে জড়িত হতে উৎসাহিত করতে পারে। গণমাধ্যম বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউজ রিপোর্টিং, ডকুমেন্টারি এবং মতামতের মাধ্যমে, লোকেরা কীভাবে জটিল বিষয়গুলো উপলব্ধি করে এবং বোঝে, তা প্রভাবিত করার ক্ষমতা মিডিয়ার রয়েছে।

মোদ্দা কথায় শান্তি না থাকলে আমাদের সমাজজীবন বা দেশ তো বটেই, দুনিয়ার কোথাও আমরা শান্তিতে থাকতে পারব না। পারব যে না তার প্রমাণ এখন চোখের সামনে। আমরা নিশ্চয়ই তেমন দেশ বা সমাজ চাইনি, যা দিনরাত খালি হুমকি-ধমকি আর মারামারিতে লেগে থাকবে। পরাজিতরা আস্ফালন না করে মার্জনা চায় না। তারা দখলবাজি করে আসতে চায়। এও এক অসুস্থ প্রবণতা। পালিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কেন তৈরি হয়, এটা না বুঝলে তাদের দ্বারা কীভাবে শান্তি আনয়ন সম্ভব?

গৌতম বুদ্ধের গল্পে পড়েছি, শান্তি এমন এক বস্তু বা বিষয়, যা ইগো মেজাজ আর অধৈর্য থাকলে পাওয়া যায় না। এর সবই এখন টগবগ করছে। সবাই কেমন জানি অস্থির। নাটক ভালো না, গান ভালো না, সিনেমা ভালো না। এ ভালো না, ও ভালো না। তাহলে ভালো কী? ভালো কে? এমন করতে থাকলে তো সুকুমার রায়ের ছড়ার মতো: কিন্তু সবার চাইতে ভালো পাউরুটি আর ঝোলা গুড় বলেই দিন কাটাতে হবে।

একটি গল্পের কথা মনে পড়ল। মহাভারতের এই গল্পটি অনেকেরই জানা। অর্জুনপুত্র মহাবীর অভিমুন্য তখন তার মা সুভদ্রার গর্ভে। অর্জুন পুত্রবতী পত্নীকে গল্প বলতেন। একদিন তিনি গুরু দ্রোণাচার্যের তৈরি করা চক্রব্যূহের গল্প শোনাচ্ছিলেন। ব্যূহ ভেদ করার অংশটুকু শুনেছিলেন, কিন্তু ব্যূহ থেকে বের হওয়ার গল্প শোনার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সন্তানসম্ভবা জননী সুভদ্রা। মাতৃগর্ভে সন্তান অভিমুন্য ওইটুকুই জানতেন।

কুরুক্ষেত্রের মহারণে বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে চক্রব্যূহ ভেদ করলেও বের হতে পারেননি অভিমুন্য। সেখানেই তাকে বধ করে কৌরবেরা। শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা অর্জুনপুত্রের এই পরিণাম স্মরণ করিয়ে দেয়, যে কোনো জালে ঢোকার আগে বেরোনোর পথ জানতে হয়। নয়তো পরিণাম ঠেকানো যায় না।

এর মানে আপনি যে কাজে নামুন না কেন, আগে জেনে নেবেন এর পরিণাম বা পরিত্রাণ কী? কীভাবে উদ্ধার সম্ভব। তা যদি না হয়, আপনি তো আটকালেনই; আপনাকে যারা বিশ্বাস করেছিল তাদেরও আটকে থাকতে হবে। একটি কবিতা পড়েছিলাম:

সতর্কতার বাণী শুনুন,

মহান আত্মার ঠোঁট

থেকে, জীবনের মালিকের কাছ থেকে, যিনি তোমাকে তৈরি করেছেন!

“আমি তোমাকে শিকার করার জন্য জমি দিয়েছি,

আমি তোমাকে মাছের জন্য স্রোত দিয়েছি,

আমি তোমাকে ভাল্লুক এবং বাইসন দিয়েছি,

আমি তোমাকে রো এবং হরিণ দিয়েছি,

আমি তোমাকে ব্র্যান্ট এবং বিভার দিয়েছি,

বন্য-পাখিতে জলাভূমি ভরা,

মাছে ভরা নদী ভরা:

তাহলে কেন তুমি সন্তুষ্ট নও?

তাহলে কেন একে অপরকে শিকার করবে?

মানুষে মানুষে হানাহানি আর শিকারের প্রবণতা পুরোনো। আমরা তার খপ্পরে পড়ি বারবার। দিনশেষে সে একই মানুষ। সে পরিচিত জনপদ আস্তানা মানুষের প্রিয় মুখ। সে কারণেই আজ শান্তির দরকার সবচেয়ে অধিক। আপনি দেশ ও দেশের বাইরের যে কোনো বাঙালিকে প্রশ্ন করে দেখুন, সবাই বলবে আমরা আর কিছু চাই না, শুধু শান্তি চাই।

মহাত্মা গান্ধী বলতেন, চোখের বদলে চোখ চাইলে দুনিয়া একসময় অন্ধ হয়ে পড়বে। আর চোখ নয়, চাই দৃষ্টি। চাই শান্তিপূর্ণ বাঙালি জীবন।

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কলামিস্ট ও সাহিত্যিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী দাবি করে ট্রাম্পের বক্তব্যের ফ্যাক্ট চেক

যেভাবে গ্রেপ্তার হলেন শাহজাহান ওমর

দায়িত্ব নিলেন ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত আলী

মেসি-আর্জেন্টিনার পক্ষে ছিল রেফারি, অভিযোগ পেরু তারকার

বিদেশ যাওয়া হলো না কলেজছাত্র জাকিরের

সাবেক এমপি শাহজাহান ওমর গ্রেপ্তার

তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি

জাতীয় দলে ফেরার প্রশ্নে যা বললেন সাকিব

সশস্ত্র বাহিনী দিবস: ঢাকা সেনানিবাসে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশিসহ মালদ্বীপে ৩৯ অভিবাসী আটক

১০

মার্কিন আদালতে অভিযুক্ত আদানি, পরোয়ানা জারি

১১

হাসিনার পক্ষে ট্রাইব্যুনালে দাঁড়াতে চান জেড আই খান পান্না

১২

মির্জা ফখরুলের সঙ্গে বৈঠকে ভুটানের রাষ্ট্রদূত

১৩

শীতকালীন সবজিতে বাজার সয়লাব হলেও দাম কমেনি

১৪

দেশে ফিরলেন বিশ্বজয়ী হাফেজ আনাস

১৫

আইজিপির দায়িত্ব নিলেন বাহারুল আলম

১৬

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬ কিলোমিটার যানজট

১৭

আগামী নির্বাচনের সময় জানালেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত

১৮

মানসম্পন্ন জলবায়ু অর্থায়নের আহ্বান জানাল বাংলাদেশ 

১৯

ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

২০
X