গৌরব ও ঐতিহ্যের ১৮৩ বছর পেরিয়ে ১৮৪তম বছরে পদার্পণ করেছে উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজ। ১৮৪১ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা কলেজ। ঢাকা কলেজ বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। ঢাকা সরকারি স্কুল হিসেবে ১৫ জুলাই ১৮৩৫ সালে শুরু হয়। এটি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ইংরেজি স্কুল। স্কুলটি ভাড়া ভিত্তিতে সদরঘাটের কাছে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি পুরোনো দোতলা বাণিজ্যিক ভবনে স্থাপন করা হয়েছিল। শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা প্রথমবারের মতো ঢাকায় ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেন। ১৮১৫ সালে ইউরোপীয়দের শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলকাতা বেনিভোলেন্ট ইনস্টিটিউশনের একটি শাখা চালু হয়।
১৮১৬ সালের এপ্রিলে, লিওনার্ড চকবাজারের ছোট কাটারা বিল্ডিংয়ে ৩৯ জন প্রধানত গ্রিক এবং আর্মেনিয়ান ছাত্র নিয়ে ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল চালু হয়। প্রশ্নোত্তর পর্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, ব্যাকরণ, গণিত, বাইবেল এবং ধর্মীয় শিক্ষা শেখানো হয়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য দায়ী সরকারি সংস্থা, ২০ এপ্রিল ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে পেশ করা একটি প্রতিবেদনে ইংরেজি সাহিত্য ও বিজ্ঞান শেখানোর জন্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধীনে প্রধান শহরগুলোতে স্কুল স্থাপনের সুপারিশ করেছিল। ভারত সরকার ১৮৩৫ সালের ২৪ জুন প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। তারা ১৫ জুলাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাড়া বাড়িতে ঢাকা সরকারি স্কুল স্থাপন করা সম্ভব করে। ১৮৩৮-৩৯ সেশনে, ঢাকা সরকারি স্কুলে আটটি শ্রেণিতে ৩৪০ জন ছাত্র এবং ৭ ইংরেজসহ ১১ জন শিক্ষক ছিলেন। এটি ১৮৪১ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কলেজ নামে একটি কলেজে পরিণত হয়। কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল সদরঘাটে কলেজ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ১৮৪৪ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
ছাত্রদের প্রথম ব্যাচে ছিল মুসলিম, হিন্দু, আর্মেনীয় ও পর্তুগিজ। সে সময় ঢাকায় অনেক আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৮৪৬ সালে এর নামকরণ করা হয় ঢাকা কলেজ। ১৮৭৩ সালে, কলেজটিকে ভিক্টোরিয়া পার্কের কাছে একটি প্রশস্ত ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়, যাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পরে ১৯০৮ সালে, এটি বর্তমান কার্জন হলে স্থানান্তরিত হয়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা কলেজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে একাডেমিক কার্যক্রম এবং অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের অবনমনে। ১৯২০ সালে ঢাকা কলেজের মধ্যবর্তী শ্রেণি নিয়ে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামে আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ক্যাম্পাসে নতুন কলেজ সরিয়ে নেওয়া হয়। কার্জন হলে শুধু বিএ, বিএসসি, এমএ এবং এমএসসি ক্লাসের ব্যবস্থা ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ঢাকা কলেজের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। তৎকালীন কার্জন হল, শহীদুল্লাহ হল (ঢাকা হল), জমি এবং নিজস্ব শিক্ষক-ছাত্র ইত্যাদি প্রদানের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে, ঢাকা কলেজকে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের বাসভবনে (বর্তমান হাইকোর্ট ভবন) স্থানান্তর করা হয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল ভবনটিকে কলেজের ছাত্রাবাস করা হয়। তা ছাড়া ঢাকা কলেজের একটি অংশ নবনির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করা হয়। এর শিক্ষক, কর্মচারী, বই ও লাইব্রেরিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আহত সৈন্যদের থাকার জন্য ঢাকা কলেজকে তার দখল খালি করতে হয়েছিল এবং তারপর এটি লক্ষ্মীবাজারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
১৯৫৫ সালে, কলেজটি বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয়। কলেজ ক্যাম্পাস এখন ১৮ একর জমি জুড়ে। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ড. টি ওয়াইজ, ডব্লিউ ব্রেনাড, ডব্লিউ বুথ, এফসি টার্নার এবং পি কে রায়ের মতো অনেক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন। শওকত ওসমান, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতো প্রবীণ ব্যক্তিত্ব এখানে অধ্যাপক ছিলেন।
কলেজের প্রাথমিক স্নাতকদের মধ্যে ছিলেন খান বাহাদুর বজলুর রহিম, কলকাতার অতিরিক্ত চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট জাহেদুর রহমান জাহেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার নাজিরুদ্দিন আহমেদ।
কলেজটি ১৮৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত হয়। ১৯২১ সালে এটি সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্ত হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর, কলেজটি ১৯৯২ সালে তার এখতিয়ারের অধীনে আসে। ঢাকা কলেজ আবার ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। বর্তমানে ঢাকা কলেজে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষার্থী, ২৪০ জন শিক্ষক রয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিক কোর্সের পাশাপাশি, এটি মানবিক, সামাজিকবিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে ২০টি শাখায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম রয়েছে।
গৌরব ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কিছু সংকটও রয়েছে। বর্তমানে কলেজের বিভিন্ন সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ক্লাসরুম সংকট, একটি ক্লাসে ধারণক্ষমতা যদি হয় ৪০-৫০ জন; সেখানে ভর্তি হয় ২০০ অধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষক সংকটের কথা না বললেই নয়। সাত-আটজন শিক্ষক দিয়ে কীভাবে একটি ডিপার্টমেন্ট পরিচালনা করা সম্ভব! লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত জায়গা নেই। শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসন তীব্র সংকট। এ ছাড়া গবেষণা ও উদ্ভাবনার জন্য নেই কোনো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা।
বর্তমানে ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট, অনার্স এবং মাস্টার্সের কার্যক্রম চলমান। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইংলিশ ভার্সনে পাঠদান করানো, সেইসঙ্গে নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট এবং প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করা। কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল করা। শিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক জোরদার করা, সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। সর্বোপরি কলেজের ইতিহাস, ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধি করতে শিক্ষার মান উন্নয়নের বিকল্প নেই।
সাকিবুল হাছান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা কলেজ, ঢাকা