কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০০ এএম
আপডেট : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

খেলাপি ঋণের লাগাম টানা জরুরি

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম
খেলাপি ঋণের লাগাম টানা জরুরি

দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় গত ১০ নভেম্বর প্রকাশিত খবরে জানা যায়, খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও ২ লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। গত ১৬ বছরে আর্থিক খাতে নজরদারির অভাবে ঋণখেলাপির পরিমাণ বেড়েছে অতিরিক্ত হারে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছর গত জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৯ কোটি এবং ফাইন্যান্সে বেড়েছে ২৪ হাজার ১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী এ খেলাপি ঋণের তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাংকারদের মতে, খেলাপি বৃদ্ধির প্রকৃত অবস্থা আরও ভয়াবহ। অনেককেই এ ঋণখেলাপির আওতাভুক্ত করা হয়নি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৯ সালের শুরুতে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি, যা গত জুনে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। আগের তুলনায় এর পরিমাণ বেড়েছে সাড়ে আটগুণ।

এমন এক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এই মন্তব্য করল যখন ঋণ প্রদানে অনিয়ম, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার শিথিলতার কারণে ব্যাংক খাত বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই উচ্চ খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর স্থিতিশীলতা ও মুনাফায় প্রভাব ফেলছে, জনগণের আস্থা কমিয়েছে। এ ছাড়া তহবিল প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছিল। চতুর্থ প্রান্তিকে এর পরিমাণ কমলেও বছরওয়ারি হিসেবে উচ্চ ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ও বিনিময় হারের ত্রৈমাসিক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, খেলাপি ঋণ বেশি হলে ব্যাংকগুলোকে এ ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বাড়াতে হয়। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির জন্য মূলত খেলাপি ঋণ দায়ী। এতে আরও বলা হয়, খেলাপি ঋণ কমানো ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মূলধন পর্যাপ্ততার কোনো উন্নতি হবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো গত ১০ বছর ধরে ন্যূনতম মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যদিকে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো মূলধনের আন্ডার ক্যাপিটালাইজড অবস্থায় আছে। প্রতিবেদনে বিশেষ তারল্য সহায়তা, টাকার অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক হিসাবে ঘাটতি, তারল্য ঘাটতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ঋণ নেওয়াকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দ্রুত এসব সমস্যার সমাধান করা না গেলে সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বহুল আকাঙ্ক্ষিত বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতায় আমরা একটি স্বৈরাচারী মনোবৃত্তির সরকারের পতন ও নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের আগমন দেখেছি। আকাশচুম্বী আর তার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সরকারকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনেও এরকম বহু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে, যা তাদের যথোপযুক্তভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এমনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের বর্তমান ভগ্নপ্রায় অর্থনীতির মেরামত ও সংস্কার। অর্থনীতির মেরামত স্বল্পমেয়াদি ধারণা হলেও, তা সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিগত বছরগুলোতে কঠিন সংকটময় সময় পার করেছে এবং এখনো তা চলমান। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলা আজ সর্বজনবিদিত। ব্যাংক খাতে সুশাসনের চরম অধঃপতন ও দলীয়করণ আমাদের দেশকে আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ থেকে ‘তলাবিহীন খেলাপি ঋণের’ দেশে পরিণত করেছে। এ ছাড়া ঢালাওভাবে মুদ্রা পাচার ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির কথা আমরা সবাই অবগত। এত কিছুর মধ্যেও দেশের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি আমাদের জন্য একটি আলোচিত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১২ শতাংশ, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত বিগত সরকারের অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্ত গড়াপেটার খবর বিবেচনায় নিলে এ হার আরও বেশি হতে পারে।

যদিও অর্থনীতির তাত্ত্বিকদের মতে, নিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির জন্য যে ক্ষতিকর, সে ব্যাপারে দ্বিমত নেই। উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয়প্রবণতা কমে গেলে দীর্ঘমেয়াদে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, আমদানি খরচ, বিদেশি বিনিয়োগ ইত্যাদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি কারণে প্রভাবিত হতে পারে। অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকরা, যারা পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন, তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির করুণ শিকার। আরও উল্লেখ্য, ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন হাইপোথিসিস অনুযায়ী, উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘসূত্রতা ভবিষ্যতের জন্য আরও বেশি মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা তৈরি করে। সুতরাং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একান্ত অপরিহার্য।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধানত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন মুদ্রানীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের নীতি সুদের হার পরিবর্তনের মাধ্যমে ও মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর এরই মধ্যে মুদ্রা সরবরাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরক্ষণশীল অবস্থানের কথা জানিয়ে দিয়েছে, যা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক।

এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে নীতি সুদের হার বৃদ্ধি করেছে, যা প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু নীতি সুদের হার যে পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের মূল্যস্ফীতির হারের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তার সঙ্গে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় নিলে নীতি সুদের হার বর্তমানের ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশের ওপর নির্ধারণ করতে হবে আর তা না হলে নীতি সুদহার বৃদ্ধির সুফল পেতে দীর্ঘ অপেক্ষার পথ পাড়ি দিতে হবে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে কাম্য নয়।

লেখক: সাবেক কর কমিশনার ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান-ন্যাশনাল এফএফ ফাউন্ডেশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইজিপির দায়িত্ব নিলেন বাহারুল আলম

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬ কিলোমিটার যানজট

আগামী নির্বাচনের সময় জানালেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত

মানসম্পন্ন জলবায়ু অর্থায়নের আহ্বান জানাল বাংলাদেশ 

ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের সব ক্লাস বন্ধের সিদ্ধান্ত

জামিন পেয়েছেন শফিক রেহমান

রাশিয়ায় এবার যুক্তরাজ্যের তৈরি ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা 

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধ

বরিশালে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যুবদল নেতা গ্রেপ্তার

১০

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা

১১

বায়ুদূষণে শীর্ষে লাহোর, ঢাকার খবর কী

১২

বিচারের শুদ্ধতার জন্য ট্রাইব্যুনালে আপিলের বিধান রাখা হয়েছে : আইন উপদেষ্টা

১৩

গাজায় নিহত সেনার সংখ্যা জানাল ইসরায়েল

১৪

ট্রাম্পের দলের নেতাদের বাংলাদেশ সফরের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

১৫

যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরেছেন জামায়াত আমির

১৬

শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি-প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

১৭

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান

১৮

সৌদি যুবরাজের ভয়াবহ কেলেঙ্কারি ফাঁস

১৯

প্রশাসন জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে: সরফুদ্দিন সান্টু

২০
X