ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গত রোববার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে গত একশ দিনে এ সরকারের নানা কার্যক্রম-পদক্ষেপ, অগ্রগতি, সাফল্য, সীমাবদ্ধতা, চ্যালেঞ্জ এবং অনাগত সময়ের পরিকল্পনা, বিশেষ করে সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ সম্পর্কে অবস্থান তুলে ধরা হয়। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই মুহূর্তে দেশে পরিবর্তিত বাস্তবতায় এ ভাষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন পর্যন্ত আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কার এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। তিনি জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরতের ব্যাপারে কথা বলেন। আশ্বাস দেওয়া হয় পতিত সরকারের গুম ও হত্যার বিচারের। তুলে ধরা হয় অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সরকারের আন্তরিকতার কথা। পাশাপাশি এ সময়ে সরকারের কিছু সাফল্যের দিক তুলে ধরা হয়। যেমন—ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন হওয়া, বিধ্বস্ত অর্থনীতিতে উন্নতির লক্ষণ, কূটনৈতিক উন্নয়নসহ নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারের আন্তরিক তৎপরতার পাশাপাশি প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ নানা বিষয় উঠে আসে ভাষণে। অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে সম্প্রতি অবহেলা ও অভিযোগ ওঠে খোদ ভুক্তভোগীদের তরফ থেকে। এ ব্যাপারে সরকারের আন্তরিকতার কোনোই অভাব নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অভ্যুত্থানের কোনো শহীদ, আহত ছাত্র-শ্রমিক চিকিৎসাসেবা এবং পুনর্বাসন পরিকল্পনা থেকে বাদ যাবে না। সব আহত শিক্ষার্থী-শ্রমিক-জনতার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় সরকার বহন করবে। শহীদ পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টাকা অনুদানের পাশাপাশি চিকিৎসার প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে আরও উদ্যোগ।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর সামগ্রিকভাবেই দেশ একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি, নিষ্ক্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, জননিরাপত্তায় হুমকি, জনপ্রশাসনে অস্থিরতা, অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি, ব্যয়বহুল জীবনযাত্রাসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জে সরকার। এরপর রয়েছে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম হওয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায়। রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রয়েছে নানা অস্থিরতা ও শঙ্কা। এরই মধ্যে নির্বাচন কবে হবে বা দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহল থেকে উঠছে দাবি। এ নিয়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে কিছুটা অধৈর্যও। সব চাপ নিয়ে এগোতে হচ্ছে সরকারকে। এমন একটি পরিস্থিতিতে সংস্কার ও নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে সরকারের অবস্থান একরকমের স্পষ্ট হয়েছে বলে আমরা মনে করি। প্রধান উপদেষ্টার ভাষ্যে, সংস্কার শেষেই ভোট, ততদিন ধৈর্য ধরতে হবে। অবশ্য নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে সম্প্রতি আলজাজিরায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন—জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি চায় সংস্কার ভুলে যাও, নির্বাচন দাও—তাহলে তাই করবো। গত রোববার তার ভিডিও সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচার করেছে আলজাজিরা।
আমরা মনে করি, বিরাজমান বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় সংস্কার যেমন অত্যন্ত জরুরি; তেমনি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে রাজনৈতিক দলের কাছে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হস্তান্তরও আবশ্যক। এ দুই কাজই যেন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়, এজন্য সরকার ও রাজনৈতিক দল—উভয়ের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা একান্ত দরকার। আমাদের প্রত্যাশা, ভবিষ্যতের সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাবে দেশ।