সাহারিয়ার রহমান রাজু
প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৫ এএম
আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন কি অবহেলিতই থাকবে

শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন কি অবহেলিতই থাকবে

গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছে। এরই মধ্যে তিন মাস অতিবাহিত হয়েছে এবং পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে সরকার এখন নানানরকম কমিশনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ পর্যন্ত অনেক কমিশন ঘোষিত হলেও শিক্ষা খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে সরকারপক্ষের কেউ কোনো কথা বলছেন না। অথচ এ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ কয়েকজন অধ্যাপক রয়েছেন, যাদের কাছ থেকে ছাত্র-জনতার শিক্ষা খাতে সংস্কার নিয়ে অনেক বেশি আশা ছিল। পারতপক্ষে, এ মুহূর্তেই শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি স্বাধীন এবং কৌশলগত মনোযোগ সর্বাগ্রে দেওয়া প্রয়োজন ছিল; যাতে দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিকভাবে যেখানে অন্য খাতে যথেষ্ট মনোযোগ এবং বরাদ্দ থাকে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাত বারবার অবহেলিত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী সরকারগুলো এ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে এবং বহু বছরের জমে থাকা ঘাটতি দূর করতে তাই একটি স্বাধীন শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হবে—এমনটাই ভেবেছিল ছাত্র-জনতা। উদ্যোগ গ্রহণ হলে এ কমিশন দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরি, প্রয়োজনীয় আর্থিক এবং কাঠামোগত সহায়তা নিশ্চিত এবং একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নেতৃত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো। বস্তুত প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা, সর্বক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা ও মনোযোগের অভাবে বাংলাদেশ এখন মারাত্মকভাবে পিছিয়ে পড়েছে এবং এর জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সংকটের সম্ভাবনা রয়েছে।

শিক্ষাকে আধুনিক বিশ্বে সমাজের অগ্রগতির মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় বিনিয়োগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে বহু আগেই। কিন্তু বাংলাদেশে এই চিত্র ভিন্ন। এখানে শিক্ষা খাত বরাবরই অবহেলিত। সরকারি তহবিল এবং পরিকল্পনা এখানে মূলত অবকাঠামো, প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে, যখন শিক্ষা খাতকে গৌণ হিসেবে দেখা হয়েছে। অন্যান্য খাতের অগ্রাধিকার এবং শিক্ষার প্রতি অবহেলার এ বৈপরীত্যের কারণে একটি স্থবির ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, যেখানে পর্যাপ্ত সম্পদ, যোগ্য শিক্ষক এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। অথচ এ দুর্বল অবকাঠামোতেই বিগত সরকার একের পর এক নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলে অবস্থা আরও সঙ্গিন করে ফেলেছে। মূলত এর কুফল দীর্ঘমেয়াদি ও অনেক ক্ষেত্রেই এর ক্ষতি অপূরণীয়।

পরিসংখ্যান বলছে, শিক্ষায় বিনিয়োগ সামাজিক সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আনে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিটি অতিরিক্ত শিক্ষাবর্ষ একটি দেশের জিডিপিকে ০.৩৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। অথচ বাংলাদেশে স্বল্পমেয়াদি প্রকল্প এবং তাৎক্ষণিক ফলাফলের ওপর গুরুত্ব বেশি দেওয়া হয়; যা দীর্ঘমেয়াদি, ধীর কিন্তু টেকসই প্রভাব আনতে পারে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শিক্ষা সংস্কারকে শীর্ষ অগ্রাধিকারে রাখা উচিত এবং শিক্ষায় যথাযথভাবে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে, যারা উদ্ভাবনী শক্তি এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ উদ্ভাবনী প্রজন্মকে সামনে এগোতে সাহায্য করবে, নতুন প্রকল্পগুলোতে পরনির্ভরশীলতা কমাবে। এজন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বৃদ্ধিকে ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয়’ মনে না করে, বিনিয়োগ মনে করতে হবে।

স্বতন্ত্র শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করলে এটি বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার দীর্ঘদিনের এবং বিশেষ সমস্যাগুলো সমাধানে একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি গঠন করতে পারবে। এই মুহূর্তে একটি স্বাধীন শিক্ষা কমিশন গঠন হলে সেটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব থেকে নিরাপদ থেকে ব্যাপক গবেষণা, নীতিগত সুপারিশ এবং গঠনমূলক বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগ দিতে পারত। আমাদের বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবমুখী জ্ঞান সরবরাহ করবে। বর্তমান পাঠ্যক্রমে ডিজিটাল দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপর কিছু বিষয় থাকলেও শিক্ষার্থীরা যাতে ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বের জন্য প্রস্তুত থাকে, সেজন্য এটাকে যুগোপযোগী করতে হবে।

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, পর্যাপ্ত বেতন ও পেশাগত উন্নয়ন উচ্চমানসম্পন্ন শিক্ষকদের আকর্ষণ এবং ধরে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ফিনল্যান্ডের মতো দেশে শিক্ষকদের ভালো বেতন প্রদান করা হয় এবং কঠোর প্রশিক্ষণ নেওয়া বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশে এ ধরনের একটি মডেল বাস্তবায়ন করে অনেক সুফল পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মৌলিক অবকাঠামোর অভাব রয়েছে, যার মধ্যে ডিজিটাল রিসোর্স ও লাইব্রেরি অন্তর্ভুক্ত। একটি সংস্কার কমিশন শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার এবং ই-লার্নিং সুবিধা সহজ করতে পারে। কমিশন একটি কাঠামো তৈরি করতে পারে, যা অগ্রগতি মূল্যায়ন, বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ এবং উচ্চশিক্ষার মান বজায় রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা প্রণয়ন করতে পারে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শিক্ষার ক্ষেত্রকে পুনর্গঠন করার জন্য একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একটি স্বাধীন শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করলে শিক্ষা খাতের দীর্ঘকালীন অবহেলা দূর করা, প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করা এবং দীর্ঘমেয়াদি সাফল্যের জন্য কৌশলগত নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। বিশ্বের সেরা শিক্ষা মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং শিক্ষকদের জন্য সম্মানজনক বেতন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও পাঠ্যক্রমের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সম্পদ নিশ্চিত করে, বাংলাদেশ তার শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয় অগ্রগতির একটি শক্তিশালী ভিত্তিতে রূপান্তরিত করতে পারে। সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে, এখনই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন, যা প্রতিটি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে সফল হতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, জ্ঞান এবং সুযোগ প্রদান করবে। শুধু আজ শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পথে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, এ ভাবনা আমাদের পলিসি মেকারদের মাথায় রাখতে পারলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডক্টরাল ফেলো/ক্যাজুয়াল একাডেমিক

ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আইজিপির দায়িত্ব নিলেন বাহারুল আলম

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৬ কিলোমিটার যানজট

আগামী নির্বাচনের সময় জানালেন উপদেষ্টা সাখাওয়াত

মানসম্পন্ন জলবায়ু অর্থায়নের আহ্বান জানাল বাংলাদেশ 

ঢাকায় আসছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের সব ক্লাস বন্ধের সিদ্ধান্ত

জামিন পেয়েছেন শফিক রেহমান

রাশিয়ায় এবার যুক্তরাজ্যের তৈরি ভয়ংকর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা 

ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধ

বরিশালে তরুণীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, যুবদল নেতা গ্রেপ্তার

১০

বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা

১১

বায়ুদূষণে শীর্ষে লাহোর, ঢাকার খবর কী

১২

বিচারের শুদ্ধতার জন্য ট্রাইব্যুনালে আপিলের বিধান রাখা হয়েছে : আইন উপদেষ্টা

১৩

গাজায় নিহত সেনার সংখ্যা জানাল ইসরায়েল

১৪

ট্রাম্পের দলের নেতাদের বাংলাদেশ সফরের আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার

১৫

যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরেছেন জামায়াত আমির

১৬

শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি-প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

১৭

ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান

১৮

সৌদি যুবরাজের ভয়াবহ কেলেঙ্কারি ফাঁস

১৯

প্রশাসন জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে: সরফুদ্দিন সান্টু

২০
X