১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮ বছর পূর্তি, যা একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৫৯তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে, এ সময়ে এসে আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে গড়ে তুলতে পারি, তা নিয়ে চিন্তা করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। আধুনিক ও উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, এ বিষয় নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়া, যা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক গুণগত উৎকর্ষ সাধনে অবকাঠামোগত ম্যাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সঙ্গে একাডেমিক এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ম্যাস্টারপ্ল্যানও প্রণয়ন করা অতি জরুরি। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিম্নোক্ত গুটিকয়েক পদক্ষেপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
গুণগত শিক্ষা ও দক্ষতামুখী কারিকুলাম: আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গুণগত শিক্ষা ও দক্ষতামুখী কারিকুলাম। শুধু পরীক্ষায় ভালো ফল করার উদ্দেশ্য নয়, বরং শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি পাঠ্যক্রম তৈরি করা উচিত, যা তাদের সমস্যা সমাধান, সৃজনশীল চিন্তা ও নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা তৈরি করবে। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ইন্টারডিসিপ্লিনারি’ বা আন্তঃবিষয়ক কোর্স চালু থাকে, যা বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বিত জ্ঞান প্রদান করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোর্স চালু করা দরকার, যা শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি করবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগযোগ্য দক্ষতা দান করবে।
গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যের প্রধান মাপকাঠি হলো গবেষণা। গবেষণায় বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা নতুন নতুন উদ্ভাবনের পথ তৈরি করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও গবেষণা তহবিল বাড়ানো এবং গবেষণার সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা জরুরি। বিশেষ করে, স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানের জন্য গবেষণা কেন্দ্র ও ল্যাবরেটরি স্থাপন করা যেতে পারে। উদ্ভাবনী গবেষণার জন্য শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও উৎসাহিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে গবেষণা তহবিল সংগ্রহ করা যেতে পারে।
প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস: উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘স্মার্ট ক্যাম্পাস’ ধারণা খুবই প্রচলিত। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার শিক্ষাদানের মান উন্নত করতে সাহায্য করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রযুক্তিনির্ভর ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্য ডিজিটাল লাইব্রেরি, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা ও ক্লাউডভিত্তিক লার্নিং প্ল্যাটফর্ম চালু করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন কোর্স, ওয়ার্কশপ ও সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে, যা তাদের জ্ঞানকে বিশ্বমুখী করবে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা: আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘ইনক্লুসিভ এডুকেশন’ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকে, যেখানে সব ধরনের শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পায়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থী ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃত্তি, উপবৃত্তি ও সহায়তা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
আন্তর্জাতিকীকরণ ও বিশ্বমুখী শিক্ষা: উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য বৈশ্বিক সুযোগ তৈরি করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিনিময় কর্মসূচি, বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ ও আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করা উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা ধারার সঙ্গে পরিচিত হবে এবং তাদের জ্ঞানের ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি: উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্যের একটি বড় কারণ হলো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার করা জরুরি, যাতে শিক্ষকরা নতুন শিক্ষাদান পদ্ধতি ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সজাগ থাকতে পারেন। নিয়মিত ‘ফ্যাকাল্টি ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো এবং নতুন গবেষণা ও শিক্ষাদান কৌশল শেখানো যেতে পারে।
ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা: উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে কাজ করে। এ সহযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং কর্মজীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলা দরকার, যাতে শিক্ষার্থীরা ইন্টার্নশিপ, প্রকল্প ও গবেষণার সুযোগ পায়।
সবুজ ক্যাম্পাস ও টেকসই উন্নয়ন: টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবুজ ক্যাম্পাসের দিকে মনোনিবেশ করছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার জন্য পুনঃব্যবহারযোগ্য শক্তি, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এটি শুধু পরিবেশ রক্ষাই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে।
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণ: উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও কল্যাণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচি, কাউন্সেলিং সেবা এবং মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সেমিনার আয়োজন করা উচিত। এতে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ মোকাবিলা করতে পারবে এবং পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হবে।
স্বচ্ছতা ও সুশাসন: উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো স্বচ্ছতা ও সুশাসন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রশাসনের মধ্যে সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা চালু রাখা জরুরি। ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও কার্যকরী করা যেতে পারে।
সর্বোপরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৮ বছর পূর্তি আমাদের জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত, যেখানে আমরা অতীতের সাফল্য ও ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে পারি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে উন্নত বিশ্বের মানের সমান করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের প্রয়োজন একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও সদিচ্ছা। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণায় শ্রেষ্ঠত্ব এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা একটি বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চাই, যেখানে জ্ঞান, উদ্ভাবন ও মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটবে এবং যা দেশের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
লেখক: অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়