মাত্র দুটি অক্ষর দিয়ে লেখার মতো আমার ছোট্ট নামটি হলো ‘বালি’। সমাজে অবস্থানভেদে আমার নাম বদলে যায়। আমি কোনো ক্ষমতাধরের পা কিংবা পাদুকার নিচে পড়লে জাতে উঠে যাই। তখন আমার নাম হয়ে যায় চরণের ধূলি বা পদধূলি। তখন আমাকে পাওয়ার জন্য দেশের সংবিধানে লেখা সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী ব্যক্তিও ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। সর্বোচ্চ আসনে বসেও সেই পদগুলো না পাওয়ার বেদনা ভুলতে না পেরে কেউ কেউ বলে ওঠেন ‘উনার চরণের ধুলো আমি পাই না’। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, চরণের ধুলা না পাওয়া মানুষটি কখনো ঝড়ের কবলে পড়ে ‘আমিই তো ঝড় উঠাচ্ছি’ বলে সত্যি সত্যি মিডিয়ায় ঝড় তোলেন, আবার প্রচণ্ড ঝড়ঝাপটা সহ্য করে ক্ষমতার প্রতীক ধরে রাখেন, অথচ যার চরণের ধুলা পাওয়ার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন, তিনিই বরং হেলিকপ্টারের পাখার বাতাসে বালি উড়িয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন।
আবার ভাঙাচোরা ট্রাকে চড়ে আমিই যখন শহরময় দাবড়িয়ে বেড়াই, কিংবা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্টের কারণ হয়ে যাই, তখন ধুলো বা বালি নয়, রাগ করে আমাকে ডাকে বালু। তবে বালি, বালু আর ধুলো—যা-ই বলুন না কেন, আমি কিন্তু এই জগতে সত্যিই এক এবং অনন্য, যা মাথায় বালুভর্তি অনেকেই বোঝে না।
শিল্প, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি সব জায়গায়ই আমি নিতান্তই অপাঙক্তেয়। দুর্ঘটনাবশত চোখে অনেক কিছুই পড়তে পারে। অনেক সময় আন্দোলন থামাতে বা ডাকাতি করতে ইচ্ছা করেই মরিচের গুঁড়া চোখের দিকে তাক করে ছিটিয়ে দেয় পুলিশ কিংবা ডাকাতের দল। কোনো কোনো ডাকাতরা চোখে মলম লাগিয়ে দেয়। এতে চোখের বারোটা বাজলেও ‘চোখের মরিচ’ বা ‘চোখের মলম’ বলে কোনো প্রবাদ নেই বাংলা ভাষায়। বরং যাকে কেউ দেখতে পারে না, তাকে ‘চোখের বালি’ বলে অবজ্ঞা করাই যেন আদর্শ ভাষা। চোখের বালি নামে উপন্যাসও লিখেছেন জগৎসেরা এক কবি ও সাহিত্যিক। সেই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে এক বিশ্বসুন্দরীকে চোখের বালি সাজিয়ে সিনেমা হয়েছে। তবে আমার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমি বালি, বালিই থেকে গেলাম।
পৃথিবীর অনেক কিছুই স্থায়ী নয়। বালির বাঁধও স্থায়ী হয় না। তাই বলে ভরসা করা যায় না—এমন সবকিছুর প্রতীকী নাম বালুর বাঁধ কিংবা বালুর প্রাসাদ হতে হবে কেন? উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীর ভরাট কণ্ঠে গাওয়া ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর-বেদনার বালুচরে’ গানটি শুনে অনেকে তৃপ্ত হলেও আমার মনের দাম কেউ দেয় না। অথচ বস্তায় আমাকে ভরে বন্যায় নদীর ভাঙন ঠেকানো হয়, এটা কেউ বোঝে না, বোঝে শুধু বালির বাঁধ কোনো কাজে আসে না—এতটুকুই।
এই তো সেদিন রাজনৈতিক উত্তেজনায় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠা রাজধানীতে সেনাবাহিনী নামানো হলো। সেনানিবাসের প্রবেশদ্বারগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানো হলো। তখন নিরাপত্তা চৌকি বানানোর জন্য যে বস্তার স্তূপ ব্যবহৃত হলো, সেই বস্তার ভেতর তো আমিই ছিলাম—নাকি? কিন্তু আমার কথা কেউ লিখল না। যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙ্কার বানাতে আমার বিকল্প আজও তৈরি হয়নি। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত বস্তাবন্দি হয়ে আমি শত্রুর বুলেট-বোমা রুখে দিই, রক্ষা করি নিজ সেনাদের জীবন। অথচ যুদ্ধ শেষে সবাই ফিরে গেলেও আমি মাঠেঘাটেই পড়ে থাকি। জাদুঘরে যুদ্ধের কত স্মৃতিচিহ্ন থাকে। কিন্তু যে বালু বস্তায় থেকে শত-সহস্র বুলেট থেকে বীর যোদ্ধাদের জীবন বাঁচিয়েছে, এমন এক মুঠো বালু কিংবা বালুর বস্তা কেউ কোনোদিন কোনো জাদুঘরে রাখে না! এই দুঃখ রাখি কোথায়?
আজকাল বালুর বুকে ফসল ফলে। অট্টালিকা, এমনকি নগর, বন্দর, রাজধানীও গড়ে ওঠে বালুর বুকে। রাস্তাঘাট, উড়াল সেতু, দালানকোঠা—কোনো অবকাঠামোই বালু ছাড়া নির্মাণ করা সম্ভব নয়। অথচ শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে বালি উড়লেই আমাকে টক অব দ্য টাউন বানিয়ে ছাড়ে কেউ কেউ। স্কুল-কলেজ বন্ধ করে রেড অ্যালার্ট জারি করে। আমাকে দমনের অসিলায় পানি ছিটানোর নাম করে কত গাড়ি কেনা হলো, সেসব গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কত টাকা এদিক-ওদিক গেল—এসব তোমরা দেখ না। দেখ শুধু আমি উঠছি আর পরিবেশ দূষণ করছি। অথচ গানের সুরে সুরে ইচ্ছা করলেই তোমরা গাইতে পারো ‘জীবনটা কিছু নয়, শুধু এক মুঠো ধুলো—চৈতি বাতাসে ওরা শিমুলের তুলো’।
আমাদের মধ্যে আবার বংশ মর্যাদার ব্যাপার আছে। অনেকটা সাদিক এগ্রোর উচ্চবংশীয় ছাগলের মতো। যেমন ধরো, যাদের জন্ম সিলেটের বিশেষ অঞ্চলে, তাদের নাম সিলেট স্যান্ড। তাদের মর্যাদা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চাদের মতো। আর যারা টোকাই গোত্রের, তাদের নাম ভিটে বালি। নির্মাণকাজে সিলেট স্যান্ড দেওয়ার শর্ত আছে। এজন্য উচ্চমূল্য দেয় সরকার। অথচ এর বদলে আমাদের মেজোজন, এমনকি ছোটজনকে চালিয়ে দিলেও নির্মাণ হয়ে যায়, বিলও দেওয়া হয়। কারণ যাদের এসব দেখার কথা, সময়মতো তাদের চোখে বালি নামের টাকা পড়ে বলে তারা ঝাপসা দেখেন। এটা তাদের দোষ নয়। এ নিয়ে অবশ্য আমার দুঃখ নেই। যে দেশে রডের বদলে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সরকারি টাকায় বাচ্চাদের স্কুলের ছাদ হতে পারে, সে দেশে কোন জাতের বালু ব্যবহার করা হলো, তা কোনো ব্যাপার না।
মধ্যপ্রাচ্যের বালুর নিচে থাকা জ্বালানি তেল ছাড়া পৃথিবী অচল। এই তেল নিয়ে যুদ্ধ হয়। বালুর নিচে কোথাও কোথাও স্বর্ণ থাকে। বাংলাদেশে সাগরতীরের বালু ও চরের বালুতে মহামূল্যবান খনিজ ও পারমাণবিক উপাদান আছে বলেও মাঝেমধ্যে চমকপ্রদ খবর আসে। তবে এমন খবর আবার তখনই আসে, যখন সরকার কোনো বদনাম, ব্যর্থতা বা রাজনৈতিকভাবে বেকায়দা অবস্থা ঢাকার জন্য জনগণের চোখে ধুলো দিতে হয়। এরপর আমি বালু আবার হারিয়ে যাই। আমার নিচে থাকা তেল, পানি, স্বর্ণ সবই দামি। দাম নেই শুধু আমার।
তবে সবাই যে আমার দাম বোঝে না, বিষয়টি আবার ঠিক সেরকমও নয়। নদীর তীর ও পরিবেশ ধ্বংস হবে জেনেও সরকারি কর্তাদের চোখে ধুলোবালি দিয়ে নদীর চরের বালি অবাধে উত্তোলন হয়। অনেকে এজন্য ‘বালুখেকো’ বা ‘বালিখোর’ উপাধিও পেয়েছেন। চাঁদপুরে এমন বালুখেকো উপাধি পাওয়া এক চেয়ারম্যান ও তার পুত্র সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর গণপিটুনিতে মারা যান, যা অনৈতিক ও অপরাধ। বালুমহাল দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়। হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তার পরও বালুমহাল সমৃদ্ধ এলাকায় নিয়োগ পেতে সরকারি আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উদগ্রীব থাকেন। কেউ কেউ পুঁজি বিনিয়োগ করেও বালুমহালে পোস্টিং নেন। কিন্তু আমি বালুকে নিয়ে কেউ কোনো পোস্ট লেখে না, একটা সেলফি তোলে না—এ কেমন কথা?
আগুন নেভাতে বিশেষত জ্বালানি তেল ও বৈদ্যুতিক লাইনে লাগা আগুন নেভাতে বালু লাগে। তবে আমি বালু আবার আগুন লাগাতেও পারি। সেটা অবশ্য রাজনৈতিক আগুন। মনে আছে, ২০১৩ সালের কথা? ২০১৪ সালের শুরুতে নির্বাচন হওয়ার কথা আর তা বাতিলের দাবিতে ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘রোড টু ডেমোক্রেসি’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে তিনি নিজেই যেন রোডে বের হতে না পারেন, সেজন্য আমাকে অতিশয় পুরোনো বালুবাহী ট্রাকে ভরে খালেদা জিয়ার বাড়ির গেটে রেখে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। আর যায় কোথায়? আমি বালু হয়ে গেলাম মহাসেলিব্রেটি। দেশ-বিদেশের কত মিডিয়া কতভাবে—কত যে ছবি তুলল আমার, তা গুনে শেষ করা যাবে না। সেই বালুভর্তি ট্রাক রাখার বুদ্ধি যে পুলিশ কর্মকর্তার উর্বর মস্তিষ্ক থেকে উৎসারিত হয়েছিল, সে পুলিশ কর্মকর্তার রাতারাতি পদোন্নতিও হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এর বাইরে রাজনীতি কিংবা গণতন্ত্রের আর কী লাভ-ক্ষতি হয়েছে, তা বোঝার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি আমার নেই। তবে আমি এতটুকু বুঝি, এমন বালু দিয়ে অবরোধের কারণেই বাংলা ভাষায় ‘গোপালী’ নামে নতুন একটি শব্দ যোগ হয়েছে, আমি বালু না থাকলে এমন ‘গোপালী’ কিংবা ‘গোপালী পুলিশ’ শব্দগুলো কি জন্ম হতো?
২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি আবারও ওরা ১১ জন হয়ে আমরা ১১ ট্রাক বালু চলে এলাম গুলশানের ৬৮নং সড়কে। এখানে রয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি সাজানো নির্বাচন হয় বলে ওইদিন ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ শিরোনামে আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। আর সেই আন্দোলন হত্যা করতে কিলিং মিশনে পাঠানো হলো ১১ ট্রাক বালি। টিয়ার গ্যাসের শেল, গরম পানি, জলকামান কিংবা পিপার স্প্রে দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার বহু নজির হয়তো আছে; কিন্তু বালু দিয়ে আন্দোলন থামানো সম্ভবত এ বঙ্গেই প্রথম। তাই বহু ফরিয়াদ করেছিলাম আমার নাম গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান দিতে! কিন্তু পেছনে কার কথা কে শোনে? ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোটামুটিভাবে মিডিয়া থেকে দূরেই ছিলাম। কিন্তু ২০২০ সালে হঠাৎ আমার গায়ে কালিমা লেপ্টে দিল একদল দুর্বৃত্ত। তারা ভুলে গেল আমি পূতপবিত্র বালু। আমার জাত ভাইদের বসবাস পৃথিবীর যাবতীয় পুণ্যভূমিতে। সব ভুলে গিয়ে তারা দুর্নীতি আর টাকা পাচারে যুক্ত করল। সুতার বদলে চীন থেকে বালুভর্তি বস্তা নিয়ে কনটেইনার চলে এলো চট্টগ্রাম বন্দরে। বিদেশে সুতার দাম ডলারে পাঠিয়ে আমার চায়নিজ জাত ভাইকে আনা হলো। ফলে বালুভর্তি বস্তা পাওয়া গেল আমদানি করা কনটেইনারে। এরপর নিত্যনতুন মামলা আর নতুন খবরের শিরোনামের আড়ালে আমার নামও হারিয়ে গিয়েছিল।
চার বছর বিরতি দিয়ে আবার আমি জেগে উঠেছি সেই ১১ বছর আগে খালেদা জিয়ার বাড়ির সামনে যারা বালুভর্তি ট্রাক রেখেছিল তাদের ধরপাকড়র শুরু হয়েছে। কে গোপালী আর কে গোলাপি নয়—তা গোনার সময় নাই কারও। এ যেন ‘যে ছিল ঢাকায়—সেই যেন বালু খায়’ অবস্থা। অতএব মামলা চলবে। তবে বেশি বেশি মামলা দিলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যে হারিয়ে যায়, তার উদাহরণও আছে।
পাঠানদের মোটা বুদ্ধি নিয়ে অনেক গল্প চালু আছে। এমন একটি গল্প বালুকেন্দ্রিক। সীমান্ত এলাকায় এক ব্যক্তি প্রতিদিন এক বস্তা বালু নিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে যেত। চেকপোস্টে পাঠান সীমান্তরক্ষী বস্তায় কী আছে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর মিলত ‘বালু’। বহুবার বহুভাবে বিশেষত চিকন লোহার শিক ঢুকিয়ে চোরাচালান করা মালপত্র বা অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হয় সীমান্তরক্ষী পাঠান। কিন্তু কখনো কিছু পাওয়া যায়নি। এভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর পাঠান সীমান্তরক্ষীর চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার দিন চলে এলো। শেষ কর্মদিবসে মোটরসাইকেল আরোহীকে সে জানাল, আজই তার শেষ কর্মদিবস। সে কাউকে কিছু বলবে না মর্মে শপথ করে জানতে চাইল, বালুর বস্তা নিয়ে চলাচল করলেও পাঠানটি আসলে কি চোরাচালান করত? আরোহী উত্তরে জানিয়ে দিল, ‘মোটরসাইকেল’। এতক্ষণে পাঠানের মনে পড়ল, আসলেই তো তাই! সত্যিই তো এই আরোহী নিত্যনতুন মোটরসাইকেল নিয়েই যাতায়াত করত এতদিন। আর শুধু বস্তার দিকেই চোখ পড়ত পাঠানের, মোটরসাইকেলের দিকে নজর পড়ত না কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই পাঠান সীমান্তরক্ষী অবসরে চলে গেল। ১১ বছর পর বালুর ট্রাকের মামলা দেখে মনে হলো, দেশবাসীর চোখে ধুলাবালু ছিটিয়ে কেউ কি আবার কিছু আড়াল করতে চাচ্ছে?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত মেজর এবং গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]