একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই যুদ্ধ আমাদের অনিঃশেষ প্রেরণার উৎস। মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল গোটা জাতি। এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন ঐক্য বিরল। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এ স্বাধীনতা। এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের মুক্তি এবং স্বাধীনতা উভয়ই আসবে। অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটবে। মজলুম পাবে তার ন্যায়বিচার। মানুষের অধিকার এবং সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে প্রতিষ্ঠিত হবে গণতন্ত্র। কিন্তু এর কোনোটাই আমাদের জীবনে আসেনি। আওয়ামী লীগ বারবার মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কলঙ্কিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার শাসনামলে দুর্নীতি, দুঃশাসন, দুর্ভিক্ষ এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেননি।
এরপর অতীতের সব ভুলভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চেয়ে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার দেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নেন এবং একপর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তিনিও মুখে অবিরাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বললেও হেঁটেছেন উল্টো পথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন এবং সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছেন। কায়েম করেন কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর একে একে বেরিয়ে আসছে তার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী পৈশাচিক কর্মকাণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে রাষ্ট্রের সব স্তরে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি বিস্তৃত করেছেন। এমনই দুটি ঘটনা রোববার কালবেলায় প্রকাশিত হয়েছে।
এতে বলা হয়, আব্দুর রাজ্জাক শেখ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ২০০৫ সালে। তবে এর চার বছর আগেই ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় এএসপি হন তার ছেলে। তারপর যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান তিনি। শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুল। বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি। গত দুই যুগে অবৈধভাবে অর্জন করেছেন শত শত কোটি টাকার সম্পদ। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তার সম্পদ জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্য এক ঘটনায় বলা হয়, মৃত চাচাকে বানিয়েছেন বাবা। নিখোঁজ চাচিকে বানিয়েছেন মা। জন্মসনদ থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের সব জায়গায় বাবা-মায়ের জায়গায় ব্যবহার করেছেন চাচা-চাচির নাম। কারণ একটাই—ওই চাচা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটার সুবিধা নিতে এমন প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন একজন স্কুলশিক্ষক। তার নাম শাহ আমানউল্লাহ। তিনি তার ছেলের জন্য এমনটা করেছেন। নড়াইলের কালিয়া উপজেলার বাসিন্দা এই পরিবার। স্কুলশিক্ষক শাহ আমানউল্লাহ নিজের ছেলেকে ভাইয়ের সন্তান বানিয়েই থেমে থাকেননি, বড় ভাইয়ের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকাও আত্মসাৎ করছেন। বর্তমান চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমিয়ে দিয়েছে সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারও কঠোরভাবে মুক্তিযোদ্ধা সনদ যাচাই-বাছাই করছে। এমন পরিস্থিতিতে ধরা পড়ার ভয়ে সম্প্রতি জন্মসনদসহ সব শিক্ষা সনদ থেকে চাচা-চাচিকে বাদ দিয়ে প্রকৃত বাবা-মায়ের নাম লিখিয়ে সংশোধন করিয়েছেন।
আমরা মনে করি, এ দুটি ঘটনা উদাহরণ মাত্র। এমন অসংখ্য ঘটনা আছে, যারা হীনস্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবহার করেছেন। এদের সবাইকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। যাতে ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেউ হীনস্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে।