শিক্ষা আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু কী ধরনের শিক্ষা? শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য থাকা দরকার। কী কাজে লাগবে ওই শিক্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অথবা ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য? সেটা কি ‘কর্মমুখী শিক্ষা’ নাকি ‘জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা’ নাকি শুধুই ‘পড়তে হয় বলেই শিক্ষা’? প্রশ্নগুলো অন্যরকম মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সমাজে চলমান সমস্যাগুলোর সঙ্গে এর অতি গূঢ় যোগাযোগ আছে।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালাতে অনেক টাকা প্রয়োজন, শিক্ষকদের ভাতা তার একটি। সরকারকে যদি এ ব্যয় ভার বহন করতে হয়, তখন সরকারেরও একটি চিন্তা থাকা উচিত যে, যাদের পেছনে জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, সেই শিক্ষার্থীরা দেশের কী কাজে লাগবে? তারা দেশ থেকে যে সাহায্য পাচ্ছে, সেটা কীভাবে, কেমন করে দেশকে ফেরত দেবে? ফেরতের কথা এজন্যই আসছে যে, ওই ফেরত দেওয়া টাকাটাই কিন্তু সরকার পরবর্তী সময়ে অন্য শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারবে। অর্থাৎ, আয়-ব্যয়ের হিসাবও খুব জরুরি একটা ব্যাপার এখানে।
অথচ দেখুন, আমরা যারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছি, দেশ যে লাখ লাখ টাকা আমাদের পেছনে খরচ করেছে, আমরা এখন কোথায়? গত দুই দশকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা মেধাবীদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে, এখনো যাচ্ছে। অন্য দেশের উন্নয়নে সেই মেধা কাজে লাগছে। আমি এটা বলছি না যে আমাদের মেধারা অন্য দেশের কাজে লাগানো যাবে না। আমরা যেমন একজন জাতির অংশ, তেমনি আমরা বিশ্ব নাগরিকও বটে। কিন্তু যেহেতু বর্তমান বিশ্ব বিভিন্ন জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভক্ত, আমাদের তো নিজেদের স্বার্থের কথাটাও ভাবতে হবে, তাই না!
সেজন্য সরকারের উচিত জনগণের পরিশ্রমের টাকা যাদের পেছনে খরচ করা হচ্ছে, তাদের কীভাবে দেশের কাজে লাগানো যাবে, সেই অনুযায়ী শিক্ষার কারিকুলামগুলো তৈরি করা। আর সেইসঙ্গে এ শিক্ষার্থীরা পাস করার পর তাদের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেশের উন্নয়নমূলক কাজে নিযুক্ত রাখা যতক্ষণ না তাদের পেছনে দেশের ব্যয় করা টাকা উঠে আসে।
কেমন করে তা সম্ভব?
ধরুন, সরকার ঠিক করল যে, আগামী ৫০ বছর পর একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে। এখন একটি উন্নত দেশের মানুষের কী কী জিনিস দরকার? তাদের মাথাপিছু আয় কত হওয়া উচিত? শুধু আয় হলে তো হবে না, তাদের উন্নত স্বাস্থ্য দরকার, খাবার দরকার, কাপড় দরকার, বাসস্থান দরকার, উন্নত চরিত্র দরকার। আর এগুলোকে নিশ্চিতকরণের জন্য দরকার দক্ষ জনবল যাদের কেউ হবে ডাক্তার, কেউ হবে ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, আবার কেউবা ব্যবসায়ী, ছোট-বড় চাকরিজীবী/শ্রমিক বা কৃষক। আমাদের কিন্তু বাস/ট্রেন ড্রাইভার কিংবা রিকশাচালকও দরকার। আর সেইসঙ্গে দরকার মোবাইল/রিকশা/গাড়ি মেকানিক বা ছুতার মিস্ত্রি।
এখন একটি উন্নত দেশ হতে হলে কোন ধরনের মানুষ কী পরিমাণে দরকার হবে, সেটা যদি সরকার একবার ঠিক করে ফেলতে পারে আর সেভাবে যদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাহলে কিন্তু আর ঝামেলা থাকে না। সরকারের ব্যয়কৃত টাকা উঠে আসতেও সময় লাগবে না।
এখানে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে মাথাপিছু বা পরিবারপিছু আয় বাড়াতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে বর্তমানে যদি প্রতি পরিবারে গড়ে পাঁচজন সদস্য থেকে থাকে, তাহলে দেশে মোট পরিবারের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩.৫ কোটি। শুধু মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করলে একটি পরিবারের প্রতি মাসের ব্যয় কত হতে পারে? ধরি, সঠিক ডায়েট অবলম্বন করে প্রতিদিন যদি খাদ্যের জন্য মাথাপিছু ৩০০ টাকা খরচ হয়, তাহলে মাসে একটি পরিবারের লাগবে ৪৫ হাজার টাকা, যা বছরে ৫ লাখ ৪০ হাজারে গিয়ে দাঁড়াবে। এভাবে বাংলাদেশের ৩.৫ কোটি পরিবারের জন্য ১ হাজার ৫৭৫ বিলিয়ন টাকা প্রয়োজন হবে শুধু খাদ্য জোগানের জন্য। সবার যদি বছরে ছেলেদের দুটি করে শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি, সোয়েটার, চাদর, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, আন্ডারপ্যান্ট, জুতো, স্যান্ডেল আর একটি করে স্যুট, সেইসঙ্গে মেয়েদের দরকারি কাপড়গুলো সমভাবে লাগে, তাহলে বছরে প্রত্যেক পরিবারের গড়ে প্রায় ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। সেই হিসাবে বছরে বাংলাদেশের সব পরিবারের মোট ৭ হাজার বিলিয়ন টাকার প্রয়োজন।
এবারে আসি বাসস্থানের ক্ষেত্রে। প্রতি পাঁচজনের একটি তিন বেডরুমের বাসার বর্তমান ভাড়া গড়ে ২৫ হাজার টাকা। সেইসঙ্গে গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি, পানি, সার্ভিস আর সিকিউরিটিসহ আরও ১৫ হাজার টাকা হলে, মোট খরচ হবে ৪০ হাজার। সেই হিসাবে, বাসস্থান বাবদ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রয়োজন প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিলিয়ন টাকার।
শিক্ষা ও চিকিৎসা যদি ফ্রি করে দেওয়া হয় বাংলাদেশে, তাহলেও শিক্ষক, চিকিৎসক, সরঞ্জাম আর অবকাঠামোর জন্য একটা খরচ লাগবেই। এ ক্ষেত্রে, সুইজারল্যান্ডকে আমরা যদি অনুসরণ করি, তাহলে প্রতি এক হাজারজনের জন্য লাগবে ৩.৬০ জন ডাক্তার। সেই হিসাবে ৬ লাখ ১২ হাজার ডাক্তার প্রয়োজন আমাদের।
দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ৭০ লাখ। প্রতি ২৫ জনের জন্য একজন শিক্ষক দরকার হলে ১৪ লাখ ৮০ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রয়োজন। আর সরকার যদি এসব শিক্ষক ও ডাক্তারের ব্যয় বহন করে এবং প্রত্যেকের বেতন বছরে গড়ে ১২ লাখ টাকা হয়, তাহলে বাংলাদেশে ২ হাজার ৫১০ বিলিয়ন টাকার প্রয়োজন। সেইসঙ্গে দরকার নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, রেজিস্ট্রার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, যা এ হিসাবে সাত-আটগুণ। এভাবে আরও ১০ হাজার বিলিয়ন টাকার দরকার হবে। প্রতি এক হাজারজনের জন্য তিনটি হাসপাতাল বেডের প্রয়োজন হলে, প্রায় ৫ লাখ ১০ হাজার বেড আর ১ হাজার ২০টি হাসপাতাল প্রয়োজন হবে, যার একেকটিতে থাকবে ৫০০ বেড। এ অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলো একেকটি বানাতে ১০০ কোটি টাকা খরচ হলে ১ হাজার ২০ বিলিয়ন টাকার প্রয়োজন। এভাবে বছরে যদি একেকজনের গড়ে ৫ হাজার টাকার ওষুধ লাগে, তাহলে ৮৫০ বিলিয়ন টাকার ওষুধ লাগবে। আর বিনামূল্যে বইপত্রের জন্যও খরচ দরকার। সব খরচ হিসাব করলে আর সুইডেনকে অনুসরণ করলে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য প্রয়োজন বছরে ১১ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এই হিসাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ লাগবে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬১৬ বিলিয়ন টাকার সমপরিমাণ অর্থ। চিকিৎসা খাতে সুইডেনকে অনুসরণ করলে, মাথাপিছু ৮ লাখ ২৮ হাজার ১২০ টাকা লাগবে। সেই হিসাবে বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনগণের জন্য প্রয়োজন ১ লাখ ৪০ হাজার ৭৮০ বিলিয়ন টাকা।
এই বিশাল ব্যয়বার বহন করা কোনো ব্যাপারই হবে না যদি বাংলাদেশ সরকার উন্নত বিশ্বের সমান করে মাথাপিছু আয়ের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশের কর্মক্ষম ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ১১ কোটিরও বেশি। প্রতিটি মানুষ মাথাপিছু বছরে গড়ে ১২ লাখ টাকা আয় করে, তাহলে তার ওপর ১০ শতাংশ ট্যাক্স বসালে সরকারের মাথাপিছু আয় হবে বছরে ১ লাখ ২০ হাজার লাখ টাকা। আর বছরে সরকারের এ খাত থেকে আসবে ১৩ হাজার ২০০ বিলিয়ন টাকা! এরপর রয়েছে করপোরেট ট্যাক্স। এভাবে জনগণের জন্য সরকার যে টাকা খরচ করবে, সেই টাকা আবার সরকারের ব্যাংকে ফিরে আসতে পাঁচ-ছয় বছরও লাগবে না। বাংলাদেশ কোনো সরকার পারবে কি এমন কোনো মহাপরিকল্পনা নিতে? সময়ই তা বলে দেবে।
লেখক: কলামিস্ট ও উদ্যোক্তা