শাহ আহমদ রেজা
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৪ এএম
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভাসানী এবং বাংলাদেশের ‘সঠিক’ ইতিহাস

ভাসানী এবং বাংলাদেশের ‘সঠিক’ ইতিহাস

আজ ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৬ সালে ৯৬ বছর বয়সে বাংলাদেশের জাতীয় এ নেতা ইন্তেকাল করেছিলেন। দেশ ও জাতির জন্য অতুলনীয় ছিল তার ত্যাগ, সংগ্রাম ও অবদান। কিন্তু তা সত্ত্বেও বছরের অন্য সময়ে তো বটেই, এমনকি মৃত্যুবার্ষিকীতেও তাকে খুব একটা স্মরণ করা হয় না। এ অকৃতজ্ঞতার পেছনে প্রধান ভূমিকা রয়েছে আওয়ামী লীগের। দলটি ক্ষমতায় এসে জাতিকে এমন এক ‘সঠিক’ ইতিহাস শেখানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে যে, ইতিহাসের সম্পূর্ণটুকুই চলে গেছে একজন মাত্র নেতার দখলে। মায়ের কোল থেকে মাটিতে পা রাখতে না রাখতে শিশুদের পর্যন্ত নামটি মুখস্থ করতে হয়েছে। ‘সঠিক’ ইতিহাস শেখানোর এ অভিযানে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উচ্চ আদালতকেও ব্যবহার করেছে। অথচ ইতিহাস তথ্য-প্রমাণভিত্তিক গবেষণার বিষয়, আদালতের রায় দিয়ে কখনো ইতিহাস তৈরি করা এবং ব্যক্তির ভূমিকা নির্ধারণ করা যায় না। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশেই এরকম উন্মত্ততার নজির নেই। লক্ষণীয় দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, এই ‘সঠিক’ ইতিহাসে দল হিসেবে শুধু আওয়ামী লীগের ভূমিকাই তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ এমন এক ‘সঠিক’ ইতিহাসই সরকার শেখানোর চেষ্টা করেছে, যেখানে নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো নেতা বা দলের কোনো অবদানের কথা নেই। উল্লেখ্য, মাত্র কিছুদিন আগেও শেখ হাসিনা বলেছেন, তার বাবাই নাকি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছেন!

অন্যদিকে ‘সঠিক’ ইতিহাস কিন্তু অমন কোনো চেষ্টাকে সমর্থন করে না। কারণ, একজন মাত্র নেতা এবং একটি মাত্র দল নয়, দেশ ও জাতির জন্য অন্য অনেক নেতা যেমন ভূমিকা পালন করেছেন ও অবদান রেখেছেন, তেমনি অবদান রয়েছে অনেক রাজনৈতিক দলেরও। উদাহরণ দেওয়ার জন্য মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা দরকার। কারণ, প্রচণ্ড হুমকি ও প্রবল বিরোধিতার মুখে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তিনি পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগই শুধু প্রতিষ্ঠা করেননি, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়েও তার ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানও মওলানা ভাসানীই প্রথম জানিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, নির্যাতন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের যে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর আজকের বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শোষণ, বঞ্চনা ও অবিচারের সূচনা হলে প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে এবং পরবর্তীকালে নিজের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ক্রমাগত তীব্রতর করেছিলেন। মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসন চাইতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের মতো প্রতিটি প্রদেশ বা অঙ্গরাজ্যের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়েছিল।

স্বায়ত্তশাসনের বিকল্প হিসেবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা চালানো এবং জনমত সংগঠিত করা ছিল মওলানা ভাসানী পরিচালিত আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য। স্বায়ত্তশাসনসহ প্রদেশের বিভিন্ন দাবি সংবলিত ২১ দফার ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী একজন প্রধান নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ যুগে অবিভক্ত বাংলার দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতা ‘শেরেবাংলা’ আবুল কাশেম ফজলুল হক এবং আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও মূলত নেতৃত্বের কোন্দলে সেবার স্বায়ত্তশাসন পাওয়ার নিশ্চিত সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের বদৌলতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এমনকি এ ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান নাকি ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়ে গেছে! এরই প্রতিক্রিয়ায় মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৭ জুন এবং ১৯৫৬ সালের ৭ ও ১৫ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত তিনটি জনসভায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার কথা চিন্তা করবে। বলা দরকার, ওই দিনগুলোতে স্বাধীনতার কথা বলা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী নেতা মওলানা ভাসানী কোনো কিছুকে পরোয়া করেননি। সে কারণে পাকিস্তানিরা, এমনকি তার নিজের দলের অনেকেও তাকে ‘হিন্দুস্থানের দালাল’ বানিয়ে ছেড়েছিল!

অন্যদিকে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হিসেবে আয়োজিত ‘কাগমারী সম্মেলনে’ মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ তথা বিদায় জানানোর এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাধারণ ছিল না। কারণ, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ তখন পাকিস্তানের কেন্দ্রে এবং পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন ছিল। প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের উল্লেখযোগ্য অন্য নেতারা। তাদের প্রত্যেকেই সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানানোয় মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। সে কারণে মওলানা ভাসানীকে তার নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন একটি দল গঠন করেছিলেন (জুলাই, ১৯৫৭)। এর পর মওলানা ভাসানী ন্যাপের মাধ্যমে তার স্বাধীনতামুখী স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েছেন। এ সময়ের ইতিহাস জানার জন্য পাঠকরা আমার রচিত গবেষণা গ্রন্থ ‘ভাসানীর কাগমারী সম্মেলন ও স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম’ (১৯৮৬) পড়ে দেখতে পারেন।

১৯৬৯-এর যে গণঅভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন স্বীকার করে নিতে বাধ্য করেছিল, সে গণঅভ্যুত্থানের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেটা এমন এক সময়, যখন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে ছিলেন (১৯৬৬ সালের মে থেকে বন্দি শেখ মুজিবের পক্ষে কোনো ভূমিকা পালন করাই সম্ভব ছিল না)। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানী ‘ঘেরাও’ নামের এক নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা গভর্নর হাউস (বর্তমান বঙ্গভবন) ঘেরাও করেছিল। এই ঘেরাও আন্দোলনের পথ ধরেই প্রদেশের তিন ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ভাসানীপন্থি মেনন গ্রুপ), আওয়ামী লীগ অনুসারী পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং মস্কোপন্থি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সংগঠন তিনটির সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত হয়েছিল ছাত্র সমাজের ১১ দফা আর ১১ দফাভিত্তিক গণঅভ্যুত্থানেই পতন ঘটেছিল সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়েছিল এবং মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবসহ রাজনৈতিক বন্দিরা। স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ও তখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকের আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ষড়যন্ত্র এবং এ দেশেরই কোনো কোনো নেতার প্রশ্নসাপেক্ষ ভূমিকার কারণে সেবার স্বায়ত্তশাসন আদায় করা সম্ভব হয়নি। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনও সাময়িককালের জন্য বিভ্রান্ত ও স্তিমিত হয়ে পড়েছিল। ‘ঘেরাও’ এবং কথিত ‘জ্বালাও-পোড়াও’ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ততদিনে ‘প্রোফেট অব ভায়োলেন্স’ বা সহিংসতা ও আগুনের নেতা হিসেবে পরিচিতি অর্জনকারী মওলানা ভাসানী পরিস্থিতিকে এমন একপর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, যখন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। স্বাধীনতার দাবি এসে গিয়েছিল মানুষের মুখে মুখে। স্বাধীনতামুখী এ অবস্থান থেকে জনগণকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বলা দরকার এবং ইতিহাসও প্রমাণ করেছে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ছিল সরাসরি পাকিস্তানবিরোধী সফল অভ্যুত্থান এবং তার প্রধান নির্মাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী। কোনো কোনো বিশেষ নেতা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি থাকায় আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অবস্থায়ও ছিলেন না।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও প্রবল বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে ১২ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যথারীতি চরম উপেক্ষা দেখিয়েছে, এ দেশের সব নেতাও তখন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী নিয়েছিলেন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার অবস্থান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানা থেকে তিনি ছুটে গেছেন উপদ্রুত অঞ্চলে। ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ ভাসানী এরপরই সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে আহ্বান জানানোর পরপর ৪ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে পবিত্র কোরআনের সুরা ‘কাফেরুন’ থেকে আয়াত উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘লাকুম দীনুকুম ওয়া লিয়া দীন’ ‘তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম আর আমাদের জন্য আমাদের ধর্ম)। অর্থাৎ তোমার রাস্তায় তুমি যাও, আমাকে আমার রাস্তায় চলতে দাও। এটা ছিল সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা। এর ভিত্তিতেই মওলানা ভাসানীর ন্যাপ ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন বর্জন করেছিল। প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেয়নি বলেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা এবং শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান নেতায় পরিণত হওয়া সম্ভব হয়েছিল।

নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ৭ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাঁচ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পন্থা নির্ধারণের জন্য ৯ জানুয়ারি তার উদ্যোগে সন্তোষে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বদলীয় সম্মেলন। এ সম্মেলন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। ৩ মার্চ থেকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে আরও একবার স্বাধীনতার আহ্বানমুখে সোচ্চার হয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। ৪ মার্চ এক বিবৃতিতে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। ১৭ মার্চ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়ার উচিত এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা, যার কাজ হবে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রাপ্য সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দেওয়া। শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক করার পরিবর্তে তার উচিত বাংলার সংগ্রামী নেতার ভূমিকা পালন করা। সর্বশেষ এক বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী ২৩ মার্চকে ‘লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন—যার অর্থ, ওইদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গণহত্যার অভিযান শুরু হয়েছিল। ৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সন্তোষে মওলানা ভাসানীর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তিনি আসামের ফুলবাড়ি হয়ে ১৫ এপ্রিল ভারতে প্রবেশ করেছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিতি থাকায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার তাকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দি অবস্থায় রেখেছিল। কিন্তু নিজের স্বাধীনতা হারিয়েও মওলানা ভাসানী দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে একজন প্রধান দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন। বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানদের কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন। কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তৎকালীন মস্কোপন্থি কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেওয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ ফলপ্রসূ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন।

এভাবে পর্যালোচনায় দেখা যাবে, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্ব থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানী বলিষ্ঠভাবে অগ্রবর্তী অবস্থানে থেকেছেন। সরকারের নির্যাতন, দলের ভাঙন এবং সহকর্মীদের পক্ষত্যাগের মতো কোনো বাধা বা প্রতিকূলতাই তাকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্বাধীনতার পরও তার সে দেশপ্রেমিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের শোষণ, লুণ্ঠন ও ভারতমুখী নীতি ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ভারতের সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার থেকেছেন এবং মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে, প্রায় ৯৬ বছর বয়সেও ঐতিহাসিক ফারাক্কা মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন (১৬ মে, ১৯৭৬)।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, কৃতজ্ঞতা জানানো দূরে থাকুক, অমন একজন সংগ্রামী জাতীয় নেতার নামও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা হয় না। সব মিলিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মকে বরং এ কথাই শোনানো ও শেখানো হয়েছে যেন নেতা ছিলেন মাত্র একজন এবং তিনি একাই সবকিছু করে গেছেন! এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ কর্মকাণ্ড স্মরণ করা দরকার। দেখা যাবে, নাম বদলের কর্মকাণ্ড চালাতে গিয়েও ওই সরকার মওলানা ভাসানীর প্রতি চরম অবমাননা দেখিয়েছে। যেমন বিজয় সরণিতে অবস্থিত নভো থিয়েটারের নামে ‘ভাসানীর’ স্থলে শেখ হাসিনার সরকার ‘বঙ্গবন্ধু’ জুড়ে দিয়েছিল। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো, মওলানা ভাসানী শুধু দেশ ও জাতির স্বার্থে আজীবন সংগ্রাম করে যাননি, তিনি শেখ মুজিবেরও প্রত্যক্ষ নেতা ছিলেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শেখ মুজিবও প্রকাশ্যে মওলানা ভাসানীকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছেন, পরামর্শের জন্য রাতের অন্ধকারে একাকী গিয়ে হাজির হয়েছেন সন্তোষে। সেই নেতা শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার সরকারই মওলানা ভাসানীর নাম বাদ দিয়ে সেখানে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি যুক্ত করেছিল!

সবশেষে বলা দরকার, বাংলাদেশের ‘সঠিক’ ইতিহাসে কোনো বিশেষ একজনের শুধু নয়, অন্য অনেকেরও অবদান রয়েছে—বিশেষ করে মওলানা ভাসানীর তো বটেই। মহান এই নেতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের ব্যাপারে অন্য দলগুলোও সুবিচার করতে পারেনি, যার জন্য কোনো কোনো দলকে ১৯৭৫-পূর্ব ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়। প্রতিপক্ষের সামনে মাথানত করতে হয়। কারণ, স্বাধীনতামুখী দীর্ঘ সংগ্রামে দলগতভাবে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। কোনো কোনো দলের তখন অস্তিত্বও ছিল না। সে ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর কিন্তু বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকা রয়েছে। বাস্তবিকই একজন প্রধান জাতীয় নেতার ভূমিকাই পালন করে গেছেন তিনি।

লেখক: সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘শেখ হাসিনা আ.লীগকে কবর দিয়েছেন’

স্ত্রীকে শেষ কথা শহীদ জামালের / তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি

ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে কুড়িগ্রাম

বায়ুদূষণের শীর্ষে লাহোর, ঢাকার অবস্থান কত

আ.লীগ নেতা ডন গ্রেপ্তার

আজ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকাজ বন্ধ

আমরা কি মানুষ নই? বৈরুতে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২০

সাবেক প্রধান বিচারপতি রুহুল আমিন আর নেই

নতুন সিইসি ও কমিশনারদের শপথ দুপুরে

কক্সবাজারে লরির ধাক্কায় ২ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

১০

গ্রিন টি নাকি রং চা, স্বাস্থ্যর জন্য কোনটি ভালো?

১১

নিয়োগ পেয়েই অনুপস্থিত ১১ মাস

১২

যেসব এলাকায় ১০ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না আজ

১৩

টিভিতে আজ যেসব খেলা দেখা যাবে

১৪

কেমন থাকবে আজকের আবহাওয়া

১৫

২৪ নভেম্বর : ইতিহাসের আজকের এই দিনে

১৬

যুবলীগ নেতা সম্রাটের সহযোগী মাহিন গ্রেপ্তার

১৭

কুবিতে নৈশপ্রহরী ও কর্মচারীদের শীতবস্ত্র উপহার ছাত্রশিবিরের

১৮

২৪ নভেম্বর: আজকের নামাজের সময়সূচি

১৯

রোববার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

২০
X