সময় মানুষকে দ্রুত বদলে দেয়। একেকটি কাল চলে যায়, রেখে যায় কিছু পুরোনো দিনের স্মৃতি, কিছু অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা। যারা দীর্ঘদিন বাঁচেন তাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বিকশিত হয়! বেশি দিন বেঁচে থাকা মানুষের আজন্ম বাসনা। মানুষের জীবনে সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিঃসন্দেহে। বয়স বাড়লেই অভিজ্ঞতা বাড়ে, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে সময় মানুষকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এ কথা সত্য, সময় মানুষকে অনেক জিনিস শেখায়। আশি ছুঁইছুঁই বয়স যাদের তিন-তিনটে আমল দেখার সুবর্ণ সুযোগ হয়েছে তাদের ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। ব্রিটিশ শাসনামলে একবারে ছোট যারা, বাবা-মায়ের কাছে শোনা কিছু কথা ছাড়া নিজের দেখা, অন্য কোনো স্মৃতি মনে থাকার কথা নয়। অনেকের মতো আমার পিতামহকে আমি চোখে দেখিনি। বাবার মুখে শুনেছি তার কথা, কল্পদৃষ্টিতে আঁচ করেছি দীর্ঘদেহী, স্বাস্থ্যবান এক মানুষের প্রতিকৃতি। তিনি নাকি ছিলেন ভীষণ রাশভারী। বিশাল শক্তিধর মানুষটির জীবন ছিল অত্যন্ত সুশৃঙ্খল। সময়মতো আহার-নিদ্রা, বাজারঘাট নিজের হাতে করা—এর কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেননি তার জীবদ্দশায়। আগের দিনের মানুষগুলো হয়তো এমনই ছিল। আমার দাদা সম্পর্কের মানুষটি শেষ জীবনে হজব্রত পালন করেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে দেড়-দুই মাস জাহাজে চড়ে পৌঁছে ছিলেন জেদ্দা বন্দরে। সেখান থেকে হেঁটে পবিত্র মক্কা নগরীতে। আবার একগাল শুভ্র দাড়ি নিয়ে ফিরেও এসেছিলেন সুস্থ শরীরে। তবে তিনি দীর্ঘ জীবন পাননি। ষাট না পেরোতেই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাকে। সরকারি চাকরিজীবী আমার বাবাও ছিলেন ঠিক তার পিতার অনুগামী। নিজের জীবনযাপনের কোথাও অনিয়ম ছিল না তার। হেঁটে কর্মস্থলে যাওয়া-আসা, বাজার-সদায় করা, ঘরের রান্না ছাড়া বাইরের খাদ্য বর্জন—এসব ছিল তার প্রাত্যহিক জীবনের সহজ-সরল চলার পথের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তাড়াতাড়ি বিছানায় চলে যাওয়া, পরিমিত ব্যয়ে জীবনযাপনে কারও কাছে হাত পাততে হয়নি তাকে। তিনি তার উত্তরসূরিকে এমন শিক্ষাই দিয়েছেন। কিন্তু অ্যান্ট্রান্স পরীক্ষায় মেধাস্থান ছিনিয়ে নেওয়া বাবার মতো তার সন্তানরা কেউই হতে পারেনি। আগের দিনে কাউকে প্লে, কেজি বা শিশুশ্রেণিতে স্কুলে পড়তে হয়নি। তখন এমন প্রচলনও ছিল না। শিশুস্তরের পড়া বাবা-মা ঘরে বসেই শিখিয়েছেন অল্পদিনের মধ্যে। কাজেই কম বয়সেই সরকারি স্কুলে সরাসরি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ভালো রেজাল্ট করে কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষাপর্ব শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকে পড়া ছিল সহজসাধ্য ব্যাপার। তাই বলে সবাই যে একইরকম উচ্চশিক্ষিত হতে পেরেছে, তা কিন্তু নয়। যে যার মেধা-মনন আর একাগ্রতা দিয়ে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হয়েছে।
আগের দিনে কাছাকাছি মানুষজনকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ছিল এক মামুলি ব্যাপার। বাবা সবসময় আমাদের কোনো কাজিনকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাসায় রাখতেন। অর্থাভাবে যারা লেখাপড়া করতে পারে না, তাদের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়ার বাইরে বাবার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, তা হলো নিজ সন্তানদের মধ্যে সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ সঞ্চারিত করা। নিজের পরবর্তী প্রজন্মকে আদর্শবান করে গড়ে তোলা আগের দিনের মানুষের যেন এক সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। জীবনের অন্যান্য অতি প্রয়োজনীয় দিকগুলো মা-বাবারা সন্তানদের সমানভাবে রপ্ত করাতে ব্যস্ত থাকতেন। কন্যাসন্তানদের রান্নাবান্না করা থেকে শুরু করে সংসারজীবনের যাবতীয় কাজকর্মের প্রশিক্ষণ দিতেন ছোটবেলাতেই। ছেলেদের বাজার করা থেকে শুরু করে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করা, গাছগাছালি লাগানো, সাঁতার কাটা—সবই শিখতে হতো সেই ছেলেবেলায়। শরীর সুস্থ ও সবল রাখার জন্য পরিমিত খাদ্যাভ্যাস শরীরচর্চাও দিনপঞ্জির তালিকায় বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। আগের দিনের বাবা-মায়েরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন সন্তানের মানবিক গুণাবলি বিকাশের ওপর। সত্য কথা বলা, সৎ জীবনযাপনে ব্রতী হওয়ার একটি বীজ বপন করে দিতেন সেই শিশুকালেই। ভালো লেখকের বই পড়া, ভালো সিনেমা দেখা, ধর্মনির্বিশেষে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতেন বাবা-মা। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কের আনন্দ পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করা যায় আজীবন। ছেলেবেলা থেকে প্রচুর খেলাধুলা করা, গায়ে কাদাজল মাখার আনন্দের পাশাপাশি প্রাণশত্তির জোগান দেওয়ার ফল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত উপভোগ করা যায়। ছেলেবেলা থেকে খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা, রাত না জেগে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া, সূর্যাস্তের আগেই ঘরে ফেরা—এ ব্যাপারে সন্তানকে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। বাবা-মায়ের শাসন, অকৃত্রিম স্নেহ আর শাসনের মধ্যে সন্তান তরতর করে বড় হয়ে যায়। তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মায়ের এ আত্মত্যাগ যেন সন্তান কখনো ভুলে না যায়।
আজকের দিনের মা-বাবারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের গড়ে তুলতে পারেন না। পারেন না ওদের মনের মতো মানুষ করে তুলতে। ওদের বড্ড বেশি আদরে বড় করা হয়। ওদের গায়ে কাদাজল মাখতে, সাঁতার কাটতে, খেলাধুলা করতে তেমন শেখানো হয় না। শুধু বইয়ের পাতায় দৃষ্টি রাখতে শেখে ওরা। বাস্তব জীবনের কঠিন দিকগুলোর সঙ্গে ওদের পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে না। ওরা বাজারে যেতে চায় না, ঘরের কাজকর্মে উৎসাহী নয়। অনেক নিকটাত্মীয়কে ওরা চেনেই না। পাড়া-প্রতিবেশীর সঙ্গে নেই তেমন কোনো সম্পর্ক। বাইরের মানুষের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ রাখার সুযোগ করে দিতে আমরা ব্যর্থ আজকের মা-বাবা, অভিভাবকরা। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠার অনাবিল আনন্দ থেকে বঞ্চিত করা হয় ওদের। তাই ওরা হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক। ঘরে মা-বাবার সান্নিধ্যবঞ্চিত সন্তানদের বাইরের জগতে গড়ে উঠেছে সখ্য। ফলে বাবা-মা, ভাইবোনের প্রতি আকর্ষণ, দায়িত্ববোধ তেমনটা গড়ে ওঠে না। না চাইতেই সব পাওয়ায় অভ্যস্ত শিশু-কিশোর আজকাল অতিরিক্ত পাওয়ার নেশায় মেতে ওঠে। জীবনের চাহিদা ওদের ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। অল্পতে ওরা তুষ্ট থাকতে রাজি নয় ওরা। অফুরন্ত পাওয়ার নেশায় বিরামহীন ছুটে চলা ওদের কোথায় নিয়ে যায়, ওরা নিজেরাও জানে না।
বয়স বেড়ে গেলে, মানুষ বুড়ো হলে জীবনের হিসাবের খাতা সামনে তুলে ধরে। দেনা-পাওনার মতো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে চায়। এ সময় বড্ড একাকিত্বে ভোগের বয়স্ক মানুষরা। কাজের চাপ আর ক্যারিয়ার তৈরিতে আজকের যুবসমাজ সদা ব্যস্ত। দেশে, দেশের বাইরে ওদের নিয়ত ছুটে চলা সুখের আশায়। বাবা-মাকে দেওয়ার মতো সময় ওদের হাতে নেই। বেশিরভাগ বৃদ্ধ মা-বাবা আজ সন্তানের ছায়ায় থাকতে পারেন না। তাই কারও ঠাঁই হয় বৃদ্ধাশ্রমে। তারপরও সন্তানের মঙ্গল কামনায় তাদের হৃদয়ে ধরে রাখেন অনন্ত সুখ। সন্তানের সুখ দেখে কোন পিতা-মাতা আনন্দিত না হন? ঢাকায় আলাদা বিশাল বাড়ি, গাড়ি ওদের। ভীষণ কর্মব্যস্ত জীবন। ওরা বিয়ে করেছে, সন্তানও রয়েছে। শিশুসন্তানদেরও ভর্তি করিয়েছে স্কুলে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করে। সন্তান পালন করে কাজের লোক। ওরা অনেক রাত জেগে থাকে, কম্পিউটার আর সেলফোন নিয়ে মেতে থাকে। ওঠে দেরি করে। সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত করে। দুপুরে বাইরে খায়। বাজার করা, রান্না-বান্না সব চলে কাজের লোক দিয়ে। ওরা একদম হাঁটাচলা করে না, দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়েই পা রাখে গাড়িতে। বাইরের খাবার খেয়ে নানা অসুখে ভুগছে ওরা। বড্ড কষ্ট আর মায়া হয়। নতুন প্রজন্মের আগামী দিনগুলো কেমন যাবে? ওদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে! ক্যারিয়ার, অর্থবিত্তের দুর্দমনীয় আকর্ষণ, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কি এমনই চলতে থাকবে? এ থেকে বেরিয়ে আসার কি আশু কোনো সম্ভাবনা নেই? মানুষের জন্য মানুষ, জীবনের জন্য জীবন—এমনটাই তো হয়ে এসেছে চিরকাল।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী