বাংলাদেশের আটটি ইসলামিক ব্যাংকের মধ্যে বেশিরভাগই তারল্য সংকটে, আর্থিক লোকসানে, কু-ঋণে, সুশাসনের অভাবে এবং মানুষের আস্থার সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সব দায় কি পরিচালনা পর্ষদের? পরিচালনা পর্ষদ বা বড় বিনিয়োগকারীদের বাইরে, এই দায় আছে কমপক্ষে আরও পাঁচ পক্ষের।
প্রথমত, ইসলামিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা বা এগিয়ে যেতে না দেওয়ার মনোভাব পোষণকারী অনেক প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারস আছেন, যারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ইসলামিক ব্যাংকিং সম্পর্কে মানুষের আস্থার সংকট তৈরি করে এ ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করে দিতে চেষ্টারত ছিলেন এবং আছেন। তারা রাষ্ট্রপরিচালনায় আছেন, রাজনীতিতে আছেন, নীতিনির্ধারণে আছেন, রেগুলেটরি বডিতে আছেন, সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে আছেন, ইসলাম মানে এবং ইসলামী দল করে তাদের মধ্যেও আছেন। তারা সবাই এ অবস্থার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশীদার।
দ্বিতীয়ত, অনেক ইসলামিক ব্যাংক ইসলামিক অর্থনীতি বা ইসলামিক অর্থনীতির নীতি বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কনভেনশনাল ব্যাংক হিসেবে তারা গঠিত এবং পরিচালিত হয়েছে, পরে ইসলামিক ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হয় (যেমন: সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক), ব্যাংকিং আইনে সুবিধা (রিজার্ভ সম্পর্কিত) নিতে এবং ইসলামিক প্রিন্সিপালসকে ফ্ল্যাগ হিসেবে ব্যবহার করে আমানতকারীদের ওপর রিস্ক ট্রান্সফার করার সুবিধা নিতে (যদিও প্রকৃত শরিয়াহ গাইডনেস যেমন মুশারাকা (অংশীদারত্বের) ভিত্তিতে ব্যবসা করে খুবই কম)। উল্লেখ্য, ইসলামিক ব্যাংক হিসেবে রূপান্তরিত হওয়ার আগে এসব ব্যাংক আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল।
তৃতীয়ত, শরিয়াহ বোর্ড বা শরিয়াহ কমিটির সদস্যদের ইসলামিক ব্যাংকিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, ইসলামিক অ্যাকাউন্টিং এমনকি ইসলামিক বিজনেস সম্পর্কে বিশেষায়িত শিক্ষা এবং গবেষণার অভাব (এ বিষয়ে আমার গবেষণার ফল দেখতে পারেন)। বেশিরভাগ শরিয়াহ বোর্ড সদস্যদের নিয়োগ হয় ব্যক্তিগত পরিচয়ে এবং নিজস্ব স্বার্থ পূরণের জন্য। যখন ইসলামিক ব্যাংকগুলো নিয়মের বাইরে গিয়ে লোন/বিনিয়োগ দেয়, অন্যান্য কার্যক্রম করে, শরিয়াহ বোর্ড মেম্বাররা নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেন, ইমানি দায়িত্ব থেকে তখন বোর্ডের সদস্য থাকা বেশি গুরুত্ব পায়। কোটি কোটি টাকা নিয়মের বাইরে ইসলামিক ব্যাংকগুলো থেকে লোন/বিনিয়োগ নিয়ে গেলেও কোনো দিন শরিয়াহ বোর্ডের সদস্যদের দায় নিয়ে পদত্যাগ করার খবর প্রকাশিত হয়নি। বরং বোর্ড বা ওপরের মহলের ওপর দায় চাপানোর উদাহরণ আছে। মানুষের আস্থা তৈরিতে তারা ভূমিকা রাখতে পারে না।
চতুর্থত, বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উদাসীনতা অথবা নীরবতা অথবা অপারগতা অথবা ওপরের মহলের কাছে নতিস্বীকার করার প্রবণতা তাদের দক্ষ রেগুলেটর হিসেবে কাজ করতে না পারা। ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং করা, ডিরেকটিং করা বা কাউন্সেলিং করার জন্য কোনো বিশেষায়িত বিভাগ নেই, দক্ষ জনবলও নেই, আমব্রেলা পলিসি দিয়ে ইসলামিক ব্যাংকগুলোকে ঠিকভাবে সুপারভাইস করা হয় না।
সর্বশেষে ইসলামিক ব্যাংকগুলোর সিনিয়র ম্যানেজার থেকে সব লেভেলের জনবলে, ইসলামিক ব্যাংকিং বা ইসলামিক অর্থনীতি একটি ফিলোসফি হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করার আগ্রহের অভাব। জনবলের অনেকেই একটা চাকরি হিসেবে নেয়, যার কারণে লোন/ইনভেস্টমেন্ট বা অন্য ব্যাংকিং সার্ভিসে শরিয়াহ নীতি পালনে তারা কম্প্রোমাইজ করে বা নিরুৎসাহিত হয়।
ইসলামিক ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে বা বড় ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করে নয়, ইসলামিক শরিয়াহ মোতাবেক কীভাবে পরিচালিত হতে পারে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। গ্রাহকের উন্নত সেবার জন্য যেমন বাজারে প্রতিযোগী অনেক ব্যাংক দরকার, ইসলামিক শরিয়াহ পালনেও প্রতিযোগী ব্যাংক থাকা আবশ্যক। ইসলামিক ব্যাংকিং বা ইসলামিক অর্থনীতি একটি ফিলোসফি, তা প্রতিষ্ঠিত করতে প্রাসঙ্গিক সব স্টেকহোল্ডারের একসঙ্গে কাজ করাই উত্তম।
লেখক: সিপিএ