দেশে কোন এলাকায় কতটি হাসপাতাল, ল্যাব, ব্লাড ব্যাংক করা যাবে—এমন নীতিমালা কি রয়েছে? হয়তো রয়েছে; কিন্তু সবার জন্য সে তথ্য হয়তো উন্মুক্ত নয়। কেননা, তথ্য জানতে চাইলে, তা পাওয়া কঠিন। এ সুযোগটাই আমরা নিচ্ছি অনেকে। কীভাবে নিচ্ছি তার একটা ছোট উদাহরণ দিই।
ধরলাম আমি একটা হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছি। হাসপাতালের সঙ্গে আমার চুক্তি রয়েছে, যেটা স্বচ্ছ এবং অসাধু নয়। আমি খেয়াল করলাম, যদি নিজেই একটা হাসপাতাল দিই; তাহলে যে পরিমাণ আয় আমাকে দিয়ে দেওয়া লাগে, সেই পরিমাণ দেওয়া লাগবে না। আমি তখন সমমনা আরও কয়েকজনকে নিয়ে একটা হাসপাতাল দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। এখন এ হাসপাতাল করতে আমি একটা স্থাপনা ভাড়া নেব, যেটা আসলে হাসপাতাল করার নিয়তে তৈরি হয়নি এর আগে। কারণ এভাবে কেউ বাড়ি বানায় না। আমাকে তার কাঠামো পরিবর্তন করে নিতে হবে কাজ চালানোর জন্য। তাহলে যে স্থাপনা আমি নিলাম হাসপাতাল করার জন্য, তাতে সবকিছুর সুবিধা আমি চালু করতে পারব না—এটাই তো স্বাভাবিক। উদাহরণ হিসেবে চিকিৎসক উল্লেখ করলাম বলে ধরে নেওয়ার সুযোগ নেই যে, হাসপাতালের মালিকানায় শুধু চিকিৎসকরাই থাকেন। দেশের অধিকাংশ হাসপাতাল, ল্যাবের মালিকানায় আসলে চিকিৎসক নন; এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় কারা থাকতে পারবেন—এ নিয়ম আছে কি না জানা নেই। কারণ, এমন কিছু আলোচনা হতে দেখি না সচরাচর। তাই দেশে নতুন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওয়ার্ডবয় হিসেবে কয়েক বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেই অনেকেই নতুন মালিকানায় চলে যাচ্ছেন নতুন কিছু করার বাসনায়।
স্থান সংকটে বেশিরভাগ হাসপাতালে ব্লাড ব্যাংক থাকে না। হাসপাতাল চলছে কিন্তু অপারেশন হয় না এমন কয়টা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে? হয়তো হাতেগোনা। কিন্তু তাদের রক্ত কোথা থেকে আসে? অনেক হাসপাতাল সুনির্দিষ্ট ব্লাড ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এ কাজের সহযোগিতা নিয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, অনেক হাসপাতালেই এসব কাজের দায়িত্ব ওয়ার্ডবয়, ম্যানেজার, ওটিবয়দের দেওয়া থাকে বেশিরভাগ সময়ে। তারা নানান ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে কাজটি চালিয়ে নেয়। দুই ক্ষেত্রেই রক্তের মানের জটিলতা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আমাদের দেশের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অনুযায়ী, রক্ত ব্লাড ব্যাংক বিশেষায়িত ফ্রিজ থেকে বের করার ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যবহার করতে হয়; নতুবা ব্লাড ব্যাংক ফ্রিজেই সংরক্ষণ করতে হয়। হাসপাতালের নিজস্ব ব্লাড ব্যাংক ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আবার এ রক্তের উৎস কী, তা জানার সুযোগ বলতে গেলে নেই। রোগীর স্বজনরা রক্তদাতা সংগ্রহ করে না দিলে ব্লাড ব্যাংকের সংগ্রহে, যা থাকে তাই নিতে হয়। রক্ত পরিসঞ্চালনের যে নির্দেশনা রয়েছে, তাতে পাঁচটি পরীক্ষার স্ক্রিনিংয়ের কথা বলা আছে; কিন্তু রক্তের মেয়াদ রয়েছে কি না, তা পরীক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এ সুযোগটাই নেয় অসাধু ব্লাড ব্যাংকগুলো।
অনুমোদনবিহীন কোনো ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইনে। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ আমরা বলতে গেলে দেখিই না। যখনই কোনো শুদ্ধি অভিযান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়, তখন এমন ব্লাড ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। নাম বদলে নতুনভাবে শুরু করা তাদের জন্য নিত্যদিনের কাজের মতোই দাঁড়ায়। মানহীন রক্ত প্রদানের মাধ্যমে কোনো রোগীর ক্ষতি হলে বা মৃত্যু হলে ছয় বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। দুঃখের বিষয়, রক্ত নেওয়ার ফলেই যে রোগীর ক্ষতি হয়েছে—এমন প্রমাণ করার সুযোগ খুব কম। তাই অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।
নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইনের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে ব্লাড ব্যাংকের আকার কেমন হতে হবে, কী কী অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ব্লাড ব্যাংক তৈরি করার মতো বেশিরভাগ স্থাপনায় পর্যাপ্ত স্থান থাকে না। কারণ, ভবিষ্যতে ব্লাড ব্যাংক হবে এমন লক্ষ্য নিয়ে কেউ স্থাপনা তৈরি করে না। তাই যা পাওয়া যায় তার মাঝেই শুরু হয়ে কাজ। ব্লাড ব্যাংকের জন্য যে বিশেষায়িত ফ্রিজ রয়েছে, তা বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি প্রস্তুত করে না। কারণ, চাহিদা কম। তাই বিদেশ থেকে আনতে হয় এবং খরচও অনেক হয় তখন। হাসপাতালের অনুমতি ব্লাড ব্যাংক ছাড়া দেওয়া যাবে না, এমন নির্দেশনা থাকলে কিন্তু ব্লাড ব্যাংকের চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পায়; তেমনি দেশীয় কোম্পানিগুলো এসব সরঞ্জাম তৈরিতে আগ্রহ পাবে বলে মনে হয়। হাসপাতালগুলোর মধ্যে ব্লাড ব্যাংক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না থাকায় অনিরাপদ ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে; তেমনি হাসপাতালের ভেতরে অনেক সময় রক্ত সংগ্রহ করে কিচেন ফ্রিজে রক্ত সংরক্ষণ করার চেষ্টাও চলমান রয়েছে; যাতে মান বলতে গেলে থাকছেই না।
রোগীর স্বজনদের আসলে জানার বা বোঝার ক্ষমতা থাকে না কোথা থেকে রক্ত নিলে তাদের রোগীর ক্ষতি হবে না। কারণ, প্রতারকচক্র রোগীকে জিম্মি করে ফেলে বিপদের মুহূর্তে। আমাদের সরকারি দপ্তরগুলোয় জনবলের সংকট কাটানো দুরূহ ব্যাপার। তাই নিয়মিত নজরদারি করা সম্ভব হয় না বেশিরভাগ সময়ই। আবার নজরদারি করলেও দণ্ড দেওয়ার সুযোগ রয়েছে সুনির্দিষ্ট দপ্তরের। বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়া নজরদারি চালিয়ে লাভ হয় না। স্বাস্থ্য দপ্তরকেও দণ্ড দেওয়ার সুযোগদান করা উচিত, যাতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়। অসাধু চক্র যাতে ভয়ের মধ্যে থাকে।
কোন এলাকায় কতটি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান করা যাবে তার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার, যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। স্থাপনার কর্তৃপক্ষ তখন তার স্থাপনায় এমন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে কি না, তা জানার সুযোগ পাবে এবং ব্যবস্থা নিতে পারবে। স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ থাকার নীতিমালা জরুরি। যে কেউ চাইলেই যেন এমন প্রতিষ্ঠান চালানোর সুযোগ না পায় সেটি নিশ্চিত করা উচিত।
ব্লাড ব্যাংকের সঠিক পরিচালনার জন্য এ বিষয় সংশ্লিষ্ট সোসাইটিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তারা নিজেরাই কমিটি গঠন করে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে। যেহেতু ব্লাড ব্যাংকের অনুমোদন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কনসালট্যান্ট ছাড়া প্রদান করা যায় না, তাই সোসাইটির জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সম্ভব হবে এর দ্বারা। তবে এটাও নিশ্চিত করা উচিত তাদের প্রদান করা রিপোর্টের ভিত্তিতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, নয়তো অসাধু চক্রের ভেতরে ভয় ঢুকানো যাবে না।
রাষ্ট্রের সংস্কার তখনই সম্ভব হয় যখন দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজেদের সংস্কার করেন এবং সেটি ধরে রাখেন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশানাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি