অবিশ্বাস্য মনে হলেও গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক; এ দুই অঞ্চলই ফিলিস্তিনিদের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে যে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো উদ্বেগ নেই। লেবাননের ওপর আক্রমণ চলমান, যার কারণে দেশটির ভেতর নৈরাজ্য আর অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দিয়েছে। ইউরোপে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে হবে ইউক্রেনকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের জন্য কোনোরকম একটা শান্তিচুক্তি তৈরি করা হবে ওয়াশিংটনে, যার মূল নকশাকারী হবে ক্রেমলিন
গত সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হলো যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এখনো লোকে এ ঘটনাবহুল দিনটি নিয়ে আলোচনায় মুখর। ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে পুরো বিশ্ব। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী কী পরিবর্তন আসতে পারে, তা ধারণা করা খুব মুশকিল নয়।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক; এ দুই অঞ্চলই ফিলিস্তিনিদের হাতছাড়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে যে অবৈধভাবে বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কোনো উদ্বেগ নেই। অন্যদিকে লেবাননের ওপর আক্রমণ এখনো চলমান রয়েছে, যার কারণে দেশটির ভেতর নৈরাজ্য আর অস্থিতিশীলতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ইউরোপে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিতে হবে ইউক্রেনকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের জন্য কোনোরকম একটা শান্তিচুক্তি তৈরি করা হবে ওয়াশিংটনে, যার মূল নকশাকারী হবে ক্রেমলিন।
আশার বাণী আর একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বার্তা নিয়ে প্রচারণা করেছিলেন কমলা হ্যারিস। কিন্তু এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর হাতে সরকারের ক্ষমতা দেওয়ার চেয়ে দুবার অভিশংসিত এবং দোষী সাব্যস্ত এক ফৌজদারি অপরাধীর হাতে দেশের দায়িত্ব অর্পণ করাই শ্রেয় বলে মনে করেছেন আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা। এমনটা ঘটার পেছনে কারণগুলো কী হতে পারে? হয়তো নারীবিদ্বেষ, হয়তো স্বার্থান্বেষী কুচক্রীদের কারসাজি; হয়তো বহিরাগত হস্তক্ষেপ অথবা হতে পারে জনসাধারণের মতামত তৈরিতে প্রযুক্তি জগতের ভূমিকা।
আমেরিকার দুপক্ষের ভোটারদের মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, ট্রাম্প ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সিনেট আর প্রতিনিধি সভা—দুটোতেই রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে কংগ্রেসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে ট্রাম্পের হাতে। তার ওপর ট্রাম্পের পক্ষে থাকছে সুপ্রিম কোর্টের সমর্থন। এসব কারণে তার আধিপত্যের ওপর নাগরিকদের আবার নতুন আস্থা জন্মাতে দেখা যাচ্ছে। আর ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকদের দাবিদাওয়া বাস্তবায়ন করাও তার জন্য এবার সহজ হয়ে যাচ্ছে।
ট্রাম্পের কর্মসূচির তালিকায় প্রথম নামটি ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর অনতিবিলম্বে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি খুব নিপুণভাবে ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের ‘শক্তির দ্বারা শান্তি’ নীতির প্রশংসা করেছেন তিনি। অবশ্য এ বিষয়ে তিনি ভালোভাবেই অবগত যে, ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পরই কিয়েভের ওপর এমন এক শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দেবেন, যার নীলনকশা তৈরি হয়েছে ক্রেমলিনে। আর এ শান্তিচুক্তি হবে ইউক্রেনের জন্য আত্মসমর্পণের শামিল।
বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বিশ্বব্যবস্থা তৈরি হয়েছে, তা চলমান রাখার জন্যই জো বাইডেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশ ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু ট্রাম্পের চিন্তাধারা তাদের থেকে ভিন্ন। প্রায়ই তাকে জনসমক্ষে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসার গান গাইতে দেখা যায়। তার এক সহকারীর ভাষ্যমতে, তিনি বিশ্বাস করেন যে, ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার অংশ হয়ে যাওয়া। তার নির্বাচনী প্রচারণার দরুন তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে দোষারোপ করেছেন এবং বড়াই করে বলেছেন যে, চাইলে তিনি এক দিনের মধ্যে এ যুদ্ধ বন্ধ করিয়ে দিতে পারেন। তা ছাড়া গত দুই বছরে প্রতিনিধি সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবলিকানরা ইউক্রেনে অস্ত্র এবং অন্যান্য সাহায্য সরবরাহ ব্যাহত করতে বরাবরই সোচ্চার ছিল।
যতদূর রইল ফিলিস্তিনের প্রশ্ন, আরব ও মুসলিম আমেরিকানরা এবার বাইডেন-হ্যারিস প্রশাসনের অদক্ষতার কারণে ডেমোক্র্যাটদের বিপক্ষে ঢালাও ভোট দিয়েছেন। ইসরায়েলের আগ্রাসন ও গাজায় এত ফিলিস্তিনির প্রাণহানির ঘটনার পরও এ প্রশাসনের নিঃস্পৃহ আচরণ তাদের প্রতি আরব মুসলিমদের অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আবার এমনটা করতে গিয়ে তারা যেই ট্রাম্পকে নির্বাচিত করেছেন, সেই ট্রাম্পও কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু! ফিলিস্তিনি মুক্তির যে সামান্য আশা ছিল, তাও হয়তো এ নির্বাচনী ফলের কারণে নিরাশায় পরিণত হয়ে যাবে।
গত কয়েক মাসে গাজার যুদ্ধাবস্থায় যে কয়েকবার যুদ্ধবিরতির সুযোগ হয়েছে, সে কয়েকবারই নেতানিয়াহু তা বাতিল করে দিয়েছেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ দাবি করছেন। কেউ কেউ এ কথাও বলছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাইডেন প্রশাসনের দুর্বলতা তুলে ধরার জন্য কৌশলে এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন শেষে ভোট গণনার সময়ই নেতানিয়াহু তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইওয়াভ গ্যালেন্টকে পদচ্যুত করেন। আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার ওপর থেকে চাপ কমিয়ে দেবেন বিধায় তিনি তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদকে আরও চরমপন্থি করে গড়ে তুলছেন। গাজায় সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য জায়গায়ও তারা ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলছে। অন্তত আরও দুই প্রজন্মের ফিলিস্তিনিরা সরাসরি এ রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হতে চলেছে।
যদিও ট্রাম্প কথা দিয়েছিলেন, তিনি হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন, কিন্তু শিগগিরই লেবাননের অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্যদিকে ইরানের ওপর ভারী নিষেধাজ্ঞা জারি করে ইরানের যুদ্ধ প্রতিহত করার যেই পুরোনো কৌশল, তা এবার কার্যকর হবে কি না সে বিষয়েও ধারণা করা যাচ্ছে না। কারণ গত মাসে ইরানের বিমানবাহিনী ও অস্ত্রাগারে তেল আবিবের হামলার পর, তেহরান ইসরায়েলে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তারা ইসরায়েলে আক্রমণের উদ্দেশ্যে নতুন সম্ভাব্য লক্ষ্যের তালিকা প্রস্তুত করছে।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে জটিল রাজনৈতিক খেলা থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে ভয়ের রাজনীতি পর্যন্ত—সবই তার পুনর্নির্বাচনে ভূমিকা রেখেছে। তিনি জনগণের মনে এ বিশ্বাস গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন যে, মুক্তি তার হাত ধরেই আসবে। কিন্তু এমনটাও হতে পারে যে, তাকে নির্বাচিত করার মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিকরা তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অমঙ্গল ডেকে এনেছে। এ অমঙ্গলের আগমন ধীরে ধীরে ঘটবে নাকি অতিসত্বর—তা বোঝা যাবে ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারির পর, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
লেখক: ব্রিটিশ-লেবানিজ সাংবাদিক। যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, নিরাপত্তা ও কূটনীতি বিশেষজ্ঞ এবং গণমাধ্যমবিষয়ক পরামর্শদাতা। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ