বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) এবং নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে তৈরি করা একটি নতুন গবেষণা কাজ মতামত দিয়েছে যে, ধূমপান ছেড়ে দিলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করতে পারে। আইডিএফ (আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন) অনুমান করে যে, বিশ্বে ৫৩.৭ কোটি লোকের ডায়াবেটিস রয়েছে। অর্থাৎ প্রতি দশজনে একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত এবং যেটা ২০৩০ সাল নাগাদ ৬৪৩ মিলিয়ন ছাড়াবে এবং প্রতি ৫ সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিক রোগীর মৃত্যু হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলোর মধ্যে একটি, যা সব ধরনের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশেরও বেশি। তবে টাইপ-২ ডায়াবেটিস সহজেই প্রতিরোধযোগ্য।
ধূমপান ত্যাগ করা শুধু টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিই হ্রাস করে না, তা নিয়ন্ত্রণেও অনেক সাহায্য করে এবং জটিলতার ঝুঁকি হ্রাস করে। গবেষণা প্রমাণ করে যে, ধূমপান রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। ধূমপান ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা যেমন কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, কিডনি জটিলতা এবং অন্ধত্বের ঝুঁকিও বাড়ায়। ধূমপান ক্ষত নিরাময়ে বাধা সৃষ্টি করে এবং নিম্ন অঙ্গ পঙ্গুত্বের ঝুঁকি বাড়ায়, যা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর একটি উল্লেখযোগ্য বোঝা তৈরি করে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে ও জটিলতা এড়াতে মানুষকে ধূমপান বন্ধ করতে জোরালোভাবে উৎসাহিত করে। এ কথাটি পরিষ্কার যে, ধূমপান ত্যাগ করা শুধু স্বাস্থ্যকর ফুসফুস এবং হৃদয়ের জটিলতা এড়াতে নয়; এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি হ্রাস করার ক্ষেত্রেও একটি শক্ত পদক্ষেপ। স্বাস্থ্যকর্মীরা তামাক ছাড়ার ক্ষেত্রে টাইপ-২ ডায়াবেটিসযুক্ত ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত ও গাইড করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন, একই সঙ্গে সরকারকেই এর গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করা জরুরি।
যখন ডায়াবেটিস হয় তখন শরীর এ পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না বা ইনসুলিন খুব ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারে না। যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন থাকে না বা কোষগুলো ইনসুলিনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, তখন বেশি পরিমাণে চিনি রক্ত প্রবাহে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস এবং কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
ধূমপানের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক কী: গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান টাইপ-২ ডায়াবেটিসের একটি কারণ, প্রকৃতপক্ষে যারা সিগারেট পান করবেন তাদের ধূমপান না করা লোকদের তুলনায় টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভবনা ৩০-৪০ শতাংশ বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন, তাদের ইনসুলিন ডোজ বা মাত্রা কার্যকর করতে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। একজন ধূমপায়ী যত বেশি সিগারেট পান করবেন, তার টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি তত বেশি। যে ধরনের ডায়াবেটিস থাকুক না কেন, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা আরও শক্ত করে তোলে। যদি কারও ডায়াবেটিস হয় এবং তিনি যদি ধূমপান করেন তবে ডায়াবেটিস থেকে তার বিভিন্ন জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন, হৃদরোগ, কিডনি রোগ এবং পায়ে দুর্বল রক্ত প্রবাহ যা সংক্রমণ, আলসার এবং সম্ভাব্য পা কেটে ফেলার কারণ হতে পারে (পায়ের আঙুল বা পায়ের অংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শরীরের কোনো অংশ কেটে ফেলা)। তা ছাড়া রেটিনোপ্যাথি চোখের রোগ, যা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে। পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি হাতে ও পায়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্নায়ু যা অসাড়তা, ব্যথা, দুর্বলতা সৃষ্টি করে।
তামাকজাত পণ্যগুলোতে পাওয়া নিকোটিন একটি রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থ, যা রক্তে শর্করাকে বাড়িয়ে তোলে। সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্যের রাসায়নিক পদার্থ দেহের ক্ষতি করে এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে (প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে)। দেহের এ প্রদাহ এবং নিকোটিন উভয়ই দেহের রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করে তোলে। যারা ধূমপান করেন তাদের পেটের চর্বি হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তোলে, এমনকি তাদের ওজন যদি বেশি নাও থাকে।
ধূমপান এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা চ্যালেঞ্জিং এবং ধূমপান সেটাকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে। যেহেতু নিকোটিন রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যারা ধূমপান করেন, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ধূমপান ছেড়ে দেওয়া কেন প্রয়োজন: আপনি কতবার ধূমপান করেছেন বা কখন ছেড়ে দিলে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে। আপনি যখন ধূমপান বন্ধ করবেন সেই সময় থেকে আপনার শরীর নিজেই নিরাময় শুরু করবে। যেমন—১২ ঘণ্টার মধ্যে আপনার রক্তে কার্বন মনোক্সাইড (সিগারেটের ধোঁয়া থেকে একটি বিষাক্ত গ্যাস) স্বাভাবিক হয়ে যাবে। দুই সপ্তাহ থেকে তিন মাসের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন এবং ফুসফুস আগের চেয়ে উন্নত হবে। এক বছরের মধ্যে, আপনার রক্ত সঞ্চালন অনেক বেশি স্বাভাবিক হবে। এক বছরের মধ্যে আপনার হৃদরোগ ঝুঁকি যারা এখনো ধূমপান করে এমন ব্যক্তির চেয়ে অর্ধেক নেমে আসবে। ধূমপান ত্যাগ করলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা আরও সহজ করতে সহায়তা করে। শরীর ধূমপানমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়া পর্যন্ত রক্তে শর্করার পরিমাণ ঘন ঘন পরীক্ষা করতে হবে।
ডায়াবেটিস কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়: ধূমপান করবেন না। কারণ ধূমপান আপনার টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ায়, ওজন বেশি হলে ওজন কমানোর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অনেক জরুরি।
ঘন ঘন সিগারেট গ্রহণকারী ধূমপায়ীদের আরও ওজন বাড়তে পারে। এমনকি যদি ওজন বেশি না হয় তবুও পেটের ফ্যাট ইনসুলিন প্রতিরোধের এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ধূমপানের কারণে অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন—‘খারাপ এলডিএল’ কোলেস্টেরল বাড়তে পারে। একইভাবে ‘ভালো এইচডিএল’ কোলেস্টেরল হ্রাস পেতে পারে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ট্রাইগ্লিসারাইডগুলোও বাড়ায়। এগুলো রক্তের মধ্যে এক ধরনের চর্বি। সুতরাং, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা, গুল, সাদাপাতা অথবা বর্তমান সময়ে নতুন আমদানি ই-সিগারেট বা ইলেকট্রনিক সিগারেট সবই ডায়াবেটিস রোগের যেমন কারণ হতে পারে, তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সেইসঙ্গে অন্যান্য জটিল রোগ যেমন হৃদরোগ, অন্ধত্ব ও নার্ভের সমস্যাসহ পায়ের পচনশীল রোগ গ্যাংগ্রিন হতে পারে। অতএব, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যেমন নিয়মিত ব্যায়াম, খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও জীবনযাপন পরিবর্তন করতে হবে তেমনি ধূমপান ও তামাক জাতীয় সব বস্তু জর্দা, গুল, সাদাপাতা জীবন থেকে বর্জন করতে হবে।
ধূমপান ছেড়ে দিতে নিজের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, তবে অনেক ক্ষেত্রে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ প্রয়োজন হতে পারে। ধূমপান ত্যাগ করলে নিজেকে যেমন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করা যাবে, তেমনি পরিবার বা পারিপার্শ্বিক জনসাধারণের জীবন ঝুঁকিমুক্ত থাকবে। তাই আজই ধূমপান ও তামাক ছাড়ুন।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা (একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক)
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস-মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা