সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০২ এএম
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বিজয়ের পর এবং তারপর

বিজয়ের পর এবং তারপর

এ বছরের জুলাই মাসটা ছিল উত্তর আন্দোলনের। মানুষ ফুঁসে উঠেছে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু জুলাইয়ের প্রথম তারিখ থেকেই। কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী হয়ে উঠলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তীব্র আন্দোলনে ভয়ের সংস্কৃতি অতিক্রম করে মানুষের ত্যাগ-আত্মত্যাগে পতন ঘটে জাতির বুকে চেপে থাকা ফ্যাসিবাদী সরকারের। এরপর আমরা কী দেখছি। বিজয়ের আনন্দ ক্রমেই বিষাদে পরিণত হওয়ার উপক্রম। নিচের বর্ণনায় তারই আভাস পাচ্ছি বটে।

এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুবার বহিরাগতদের হামলার ঘটনা ঘটেছে; একটিতে একজন ছাত্রের মৃত্যু ঘিরে একজন চিকিৎসক অপমানিত ও প্রহৃত হন; অন্যটিতে ঢাকার এক মহল্লায় দুপক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষে একপক্ষের একজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে অন্যপক্ষ চাপাতি হাতে ইমার্জেন্সিতে এসে আহতপক্ষের ওপর চড়াও হয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, তারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু এখন হামলার শিকার হচ্ছেন। এর প্রতিবাদে পরদিন দেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা একযোগে দিনভর কর্মবিরতি পালন করেছেন। পরে কর্মবিরতি স্থগিত করে তারা ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন চার দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। সমাজে পেশাগত যত সম্পর্ক আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক হওয়ার কথা চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক; সেটাতে যখন ভাঙন দেখা দেয়, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, মনুষ্যত্বই বিপদাপন্ন হয়েছে। মনুষ্যত্ব-বিনষ্টকারী পুঁজিবাদী বাস্তবতাটা ভাঙতে হলে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন; এ সত্যটা আমরা যেন না ভুলি।

এরই মধ্যে তো চতুর্দিকে দেখা দিয়েছে নতুন একের পর এক দাবিদাওয়া আদায়ে আন্দোলনের তরঙ্গপ্রবাহ। সেটা দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য নানা ধরনের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ-সমাবেশ এবং ঘেরাও। দাবিগুলো চাপা ছিল, প্রকাশের পথ পেয়ে মুখর হয়ে উঠেছে এবং প্রত্যেকটি দাবির ভেতরেই রয়েছে বৈষম্যের খবর। প্যাডেল-চালানো রিকশাওয়ালারা মিছিল করেছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বিরুদ্ধে। দুপক্ষই বঞ্চিত; কিন্তু একপক্ষ নিজেদের অধিকতর বঞ্চিত মনে করে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত নন-ক্যাডার চাকরিজীবীরা সমাজের অন্যান্য অনেক অংশের চেয়ে খুব খারাপ অবস্থায় যে আছেন, তা নয়; কিন্তু তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ক্যাডার-সার্ভিসে নিযুক্তদের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত জ্ঞান করে; ৪৩তম বিসিএস নন-ক্যাডাররা সম্প্রতি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দপ্তরে গিয়ে ভাঙচুর করেছেন, তালা লাগিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন কক্ষে এবং চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছেন।

আনসার বাহিনী অনেক জরুরি কাজ করে, নির্বাচনের সময় তো বটেই, অন্য সময়েও। কিন্তু তাদের নিয়োগ নিয়মিত নয়, চুক্তিভিত্তিক। তিন বছর পরপর ছয় মাস চাকরি থাকে না। আনসাররা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যের মতোই নিয়মিত হতে চান; নিয়মিত হলে চাকরির নিশ্চয়তা বাড়বে, উৎসব ভাতা, পেনশন ইত্যাদির প্রত্যাশা করতে পারবেন। বিভিন্ন সময়ে তারা দাবি জানিয়েছেন, কিন্তু তাদের নিয়মিত করা হয়নি। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৯৪-তে তারা বড় রকমের এক আন্দোলন করেন। সে ‘বিদ্রোহ’ দমনে মর্টার ও মেশিনগান ব্যবহার করা হয়। ৩০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু বৈষম্যের নিরসন ঘটেনি। এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অনুকূল আবহাওয়াতে তারা সচিবালয়ের সম্মুখে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। মনে হচ্ছিল তাদের ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে। কিন্তু ভয়ের সংস্কৃতির পাশাপাশি সন্ত্রাসের যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, তার প্রকাশ দেখা গেল এখানেও। শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ বাধল এবং সেটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের সঙ্গেই। এটাও যে বাস্তবতার একটা অংশ, তা অস্বীকার করি কী করে। ১৯৯৪-তে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২ হাজার ৫০০ আনসার সদস্যকে; এবার অবশ্য অত নয়, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৮৮ জন।

সমাজ-বাস্তবতার প্রধান দিকগুলোর একটি হচ্ছে লুণ্ঠন। যারা ধনী হয়েছে, তারা প্রায় সবাই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত এবং ওই কাজে দক্ষ। বৈধ লুটপাটেরও ব্যবস্থা আছে। সিন্ডিকেট রয়েছে। থাকবেও। সরকার পতনের পর এখানে-সেখানে লুটপাটের নানা মাত্রায় ঘটনা ঘটেছে। গণভবন থেকে জিনিসপত্র যেভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে, তাকে তো মনে হয়েছে রীতিমতো একটি উৎসব। বিপ্লবকে বলা হয় শোষিত মানুষের উৎসব। কিন্তু সেটা তো লুণ্ঠনের নয়, সৃষ্টির। গণভবনে বসবাসকারীরাও অবশ্য ওই একই কাজ করেছেন, গত ১৫-১৬ বছর ধরে। তাদের লুণ্ঠন ছিল অনেক ব্যাপক, সুশৃঙ্খল ও গুপ্ত। কিন্তু লুণ্ঠন যে কোনো অপরাধ নয়, বরং গর্ব ও গৌরবের বিষয়; এ শিক্ষাটা তারাই রেখে গেছেন শাসিত মানুষদের জন্য।

ওই শিক্ষায় শিক্ষিত, বলা যায় ওই ধর্মে দীক্ষিত মানুষরা সুযোগ পেলেই লুটপাট করে। হাত নিশপিশ করতে থাকে। ধরা যাক নারায়ণগঞ্জের গাজী পানি ট্যাঙ্ক ও টায়ারে লুণ্ঠনের ঘটনা। গাজী টায়ারের মালিক মন্ত্রী ছিলেন; ভূমি জবরদখলের অভিযোগ নিশ্চয়ই আছে, তবুও কয়েকটি শিল্পকারখানাও গড়েছিলেন, কর্মসংস্থান করেছিলেন কিছু মানুষের। ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটেছে শুনে কারখানায় প্রথম দফা লুটপাট ঘটে। পরে কারখানার মালিক গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনে মানুষ আর বাধা মানেনি। বন্যার স্রোতের মতো কারখানার ভবনগুলোতে ঢুকে পড়েছে। যে যা পেয়েছে লুণ্ঠন করেছে। ভ্যানগাড়ি, রিকশা, যা পাওয়া যায় ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে একদল আবার মূল ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়, কারণ হতে পারে লুটপাটের ব্যাপারে তাদের নিজেদের কাজ ততক্ষণে শেষ হয়েছে, এখন অন্যরা যেন তাদের কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তার ব্যবস্থা করা চাই। কারখানা ছিল দাহ্য পদার্থে ঠাসা। আগুন অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ছয়তলা ভবনটির সর্বত্র। ভেতরের আটকাপড়া লোকেরা অবরুদ্ধ অবস্থাতেই রয়ে গেছেন। পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস এসেছে পৌনে তিন ঘণ্টা পর। আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে ২১ ঘণ্টা। তারপরও ভেতরে ঢুকতে সাহস করেননি ফায়ার সার্ভিসের লোকরা। কারণ দগ্ধ হয়ে ভবনটি তপ্ত ও নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। মৃত্যু ঘটেছে কমপক্ষে ১৭৫ জনের।

লক্ষ করার বিষয় এটাও যে, লুটপাটকারীদের ভেতর ওই কারখানার কোনো শ্রমিক ছিলেন না। শ্রমিক যতই শোষিত হোন, তার কর্মস্থল যে কারখানা; সেটাতে লুটপাট চালান না, আগুন দেন না, কারণ তাতে তার জীবিকার উৎসের বিপদ ঘটবে। গাজী টায়ারের লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের কাজটা বহিরাগতরাই করেছেন, যারা অন্যত্র নিজের শ্রম বিক্রয় করে জীবিকা সংগ্রহ করে থাকেন, কিন্তু লুটপাটের সুযোগ পেলে দ্বিধা করেন না, ঝাঁপিয়ে পড়েন, প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দেন, যেমনটা গাজী টায়ারে ঘটেছে।

স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবির গুলিতে যখন শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, স্বপ্ন যাচ্ছে ভেঙে চুরমার হয়ে প্রায় সে সময়েই তো আটকেপড়া ওই মানুষগুলো প্রাণ হারালেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নয়, পাড়া-প্রতিবেশীদের হাতে, তাদের লাগানো আগুনে।

মূল বাস্তবতাটাই তার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয় এ ঘটনাতেও। নিখোঁজ (অর্থাৎ মৃত) ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শাহাদাত সিকদার এবং এবং তার ভাই সাব্বির সিকদারের বোন রহিমার কান্নায় ভেঙেপড়া বর্ণনায় একটি পরিবারের সর্বনাশ ঘটার চিত্রটা পাওয়া যায়। রহিমা জানাচ্ছেন, রাত ৯টায় কারখানায় লুটপাট হচ্ছে শুনে শাহাদাত ও সাব্বির ঘটনাস্থলে যান। শ্যালকদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না দেখে তাদের বোনজামাই জমির আলী কারখানার দিকে রওনা হন। তারপর থেকে তিনজনই নিখোঁজ রয়েছেন। নিজের তিন মেয়ে নিয়ে রহিমা নিজে তো বিধবা হলেনই, এক ভাইয়ের ছোট ছোট দুটি সন্তান রয়েছে, ভাবছেন তাদের কথাও। রহিমার বিলাপ, ‘ওদের নিয়ে কী করব কিছুই জানি না। মানুষ একজনের শোক সইতে পারে না, আমরা তিনজনের শোক কেমনে সইব?’ ঠিক একই রকম বিলাপধ্বনি শুনেছি আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নিহতদের পরিবার-পরিজনদের কণ্ঠে।

সবটা মিলিয়ে অখণ্ড এবং নির্মম এক বাস্তবতা এবং ওই একই বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ আমাদের সহ্য করতে হয়। মানুষ অভাবে আছে, শ্রমে তাদের অনীহা নেই, কিন্তু লুণ্ঠন করে যদি অনুপার্জিত সম্পত্তি পাওয়া যায়, তবে সেটা নিতে তারা সদাপ্রস্তুত; সে সম্পত্তি যতই সামান্য হোক না কেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধির কথা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবা প্রায় অসম্ভব, তা মালিক অঢেল পরিমাণে বিত্ত সংগ্রহ করে থাকুক, কি একেবারেই নিঃস্ব হোক।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

আজকের নামাজের সময়সূচি

প্রথম দিনে উইন্ডিজ তুলল ২৫০ রান

গাঁজা-জাল নোটসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক

ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের শীতবস্ত্র বিতরণ

উইন্ডিজের প্রতিরোধ ভেঙে বাংলাদেশের স্বস্তি

টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস / ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়িক অংশীদার চাই

২০২৪ সালের হাইয়েস্ট কালেকশন দরদের : শাকিব 

নায়িকা পরীমনির প্রথম স্বামী নিহত

রাজনীতিতে আ.লীগের পুনর্বাসন ঠেকাতে হবে: নুর

১০

নির্বাচন যত দ্রুত হবে, সমস্যা তত কমে আসবে : মির্জা ফখরুল

১১

খাসজমির দখল নিয়ে সংঘর্ষে দুজন নিহত

১২

মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে ক্রীড়াঙ্গন অন্যতম একটি মাধ্যম : আমিনুল হক 

১৩

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

১৪

আহত রানার পাশে ‘আমরা বিএনপি পরিবার’

১৫

ফেসবুকে দাবি ‘মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ একই ব্যক্তি’, যা বলছে ফ্যাক্ট চেক

১৬

একদিকে প্রশান্তি, অশান্তিও বিরাজ করছে: শামা ওবায়েদ

১৭

চোর সন্দেহে খুঁটিতে বেঁধে যুবককে নির্যাতন

১৮

র‍্যানকন মটরসের সঙ্গে ক্র্যাক প্লাটুন চার্জিং সলুশনের চুক্তি

১৯

জনকল্যাণে কাজ করাই বিএনপির মূল লক্ষ্য : নয়ন

২০
X