আজারবাইজানে এবারের জলবায়ু সম্মেলন বহুবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মূলত এবারের সম্মেলনে আলোচ্য সূচির শীর্ষে রয়েছে অর্থায়ন। এ নিয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ আরও বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ বিশ্বে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। এজন্য উন্নত বিশ্ব কী পরিমাণ অর্থায়ন করে, তা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ এবারে সম্মেলনের অপেক্ষা করছিল যে, উন্নত দেশগুলো জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদার কতটা পূরণ করে, তা দেখার জন্য। অন্যদিকে বছরের রেকর্ড উষ্ণায়ন, তাপপ্রবাহ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিমাত্রায় বরফ পড়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়ে আলোচনার ইস্যুগুলোতে। অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ ‘পাপুয়া নিউগিনি’ এবারের জলবায়ু সম্মেলন বয়কট করেছে। এই প্রথম কোনো দেশের বয়কটের ইস্যুকে ছাপিয়ে গেছে সদ্য অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের জলবায়ু আলোচনা কোন দিকে যাবে। আর এসব কারণেই এবারের জলবায়ু সম্মেলন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত, কনফারেন্স অব দ্য পার্টিসের সংক্ষিপ্ত রূপ কপ। এটি বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতিসংঘের একটি উদ্যোগ। ১৯৯৫ সালে প্রথম কপ সম্মেলন হয়। ১৯৯৯ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ ইস্যুটি প্রথমবারের মতো সামনে আসে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বসেছে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের ২৯তম আসর। গত ১১ নভেম্বর বাকুর অলিম্পিক স্টেডিয়ামে এ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়ে চলবে দুই সপ্তাহব্যাপী। সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণে জলবায়ু সংস্থা ইউএনএফসিসিসির প্রধান নির্বাহী সাইমন স্টিল বলেন, ‘এখন কঠিন সময় যাচ্ছে। আমি এখানে আশা এবং স্বপ্ন দেখাতে চাই না। তবে আমাদের একতাবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। মানবজাতিকে বাঁচাতে লক্ষ্য পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বারবার জেগে উঠতে হবে।’
সম্মেলনে বিশ্বের শতাধিক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যোগ দিয়েছেন এবারের সম্মেলনে। ১১-২২ নভেম্বর পর্যন্ত বাকুতে ২৯তম জলবায়ু সম্মেলন হবে। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ১১-১৪ নভেম্বর তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করবেন। বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং সে কারণে বাকুতে বাংলাদেশ তার দাবিদাওয়া তুলে ধরবে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে কথা বলবে। সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থানকে গুরুত্ব দেওয়া হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতি তহবিল ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’, প্যারিস চুক্তির সবুজ জলবায়ু তহবিল এবং জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলো থেকে সবুজ প্রযুক্তিতে সহায়তা চাইতে পারে।
জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে এ শতাব্দীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। কিন্তু এ উষ্ণায়নের ইস্যুকেও ছাপিয়ে এখন প্রধান আলোচ্য ইস্যু হয়ে উঠেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প। জলবায়ু ইস্যুতে তার অবস্থান নেতিবাচক। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হয়েই তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। এসব কারণে এখন বিভিন্ন দেশের জলবায়ু প্রতিনিধিরা তাকিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প কোন পথে হাঁটবেন।
আরব আমিরাতের পর এবার দ্বিতীয় দফায় আরও একটি তেলসমৃদ্ধ দেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই সপ্তাহব্যাপী জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলনের প্রথম পর্যায়ে আজ থেকে শুরু হবে কর্মকর্তা পর্যায়ের বৈঠক। একই সঙ্গে চলবে বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে হাইলেভেল সেগমেন্ট। আর দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হবে মূল দরকষাকষি মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠক। ওই বৈঠক শেষেই পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে (প্লেনারি) সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২০২৩ সালের মতো ২০২৪ সালেও দেশে দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রলয়ংকরী তাণ্ডব। জীবাশ্ম জ্বালানির অব্যাহত ব্যবহারে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে আবহাওয়ার তীব্রতা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশকে সংকটে ফেলেছে। তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলেনি, প্রাণহানিসহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সম্পদ ও অর্থনীতির। সর্বশেষ, গত অক্টোবরে স্পেনের পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় শতাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাদেশের মানুষও এ বছর আবহাওয়ার বিপন্নতা দেখেছে। বছরের শুরুতে তীব্র শীতের পর, প্রচণ্ড দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। দীর্ঘস্থায়ী এ দাবদাহের পর বাংলাদেশ প্রলয়ংকরী বন্যার মুখোমুখি হয়। দেশের একাধিক অঞ্চলে একাধিকবার বন্যা দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ ছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা। ওই বন্যায় ওই অঞ্চলের ১১টি অঞ্চল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়। সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ঘূর্ণিঝড় রেমাল। মন্থরগতির দীর্ঘস্থায়ী এ ঘূর্ণিঝড় শুধু রেকর্ড বৃষ্টিপাতই ঘটায়নি, ৫০ ঘণ্টা দেশের ভূখণ্ডে অবস্থান করে।
গত কয়েক বছর নতুন অর্থায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিল জাতিসংঘ। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ লক্ষ্য চূড়ান্তের অপেক্ষায় আছে। এ কারণে এবারের সম্মেলনে অর্থায়নকে শীর্ষ এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এবারের কনফারেন্স অব দ্য পার্টি (কপ) হচ্ছে অর্থায়নের কপ। ফলে সবার দৃষ্টি কপ২৯-এর দিকে। এই এজেন্ডা নিয়েই এ বছর জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী চলমান জলবায়ু সংকট মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক উৎস থেকে উন্নত দেশগুলোর প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন, যা উন্নত দেশগুলোর বর্তমান প্রতিশ্রুতির চেয়ে কমপক্ষে পাঁচগুণ বেশি। আগামী বছর থেকে এ লক্ষ্য কার্যকর করার কথা। আবার এ অর্থের উৎস নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বর্তমানে বেশিরভাগ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে বেসরকারি খাত ও বহুপক্ষীয় ব্যাংক থেকে। আর এ অর্থ দেওয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে। এবারের সম্মেলনে আয়োজক দেশ আজারবাইজান দরিদ্র দেশগুলোর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ১০০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেবে।
এদিন বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ৯০০ নাগরিক সংগঠনের মোর্চা ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক তুলে ধরে উদ্বেগজনক তথ্য। তথ্যে বলা হয়, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর কাছে গ্লোবাল নর্থের দেশগুলোর জলবায়ু ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। এ ঋণের কিস্তি পরিশোধে প্রতি বছর দিতে হচ্ছে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। উন্নত দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে বিশ্বব্যাপী যে জলবায়ু বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, তার দায় গরিব দেশগুলোকে বহন করতে হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ২৮তম কপে ‘জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসতে আরব আমিরাত এক ঐতিহাসিক ঐকমত্য তৈরি করেছে। অনেকে এটিকে অসম্ভব মনে করেছিলেন কিন্তু সে অসম্ভবকেই তারা সম্ভব করেছে।’
এবারে নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর ২৯তম জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৯) সভাপতি মুখতার বেবায়েভ বলেন, ‘এটি প্যারিস জলবায়ু চুক্তির সত্যিকার মুহূর্ত। আশা করছি, এ সম্মেলন সবাইকে নতুন পথ দেখাবে।’ তাই বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বের মানুষের প্রতীক্ষার পালা প্রত্যাশিত সেই ‘নতুন পথ’ দেখার।
লেখক: সাংবাদিক ও বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সাধারণ সম্পাদক