প্রখ্যাত সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণআন্দোলনকে উপজীব্য করে লেখা এ উপন্যাসটির পরতে পরতে বর্ণিত আছে সে আন্দোলনের ইতিবৃত্ত। সেই উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র খিজির নামের এক যুবক। লম্বা, ঢ্যাঙা ও হাড্ডিসার শারীরিক গঠনের জন্য সে ‘হাড্ডি খিজির’ নামে পরিচিত। লেখাপড়া জানে না। রিকশা গ্যারেজের ম্যানেজারি করে। কখনো নিজেই চালায় রিকশা। তবে ওঠাবসা মহল্লার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। এমন কোনো মিছিল-মিটিং নেই, যেখানে হাড্ডি খিজিরের উপস্থিতি নেই। মিছিলের অগ্রভাগে তাকে হাত উঁচিয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায়। লিকলিকে শরীর থেকে তীব্র আওয়াজ বেরোয়—‘আইয়ুব মোনেম দুই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’, ‘আইয়ুবশাহি, গুন্ডাশাহি, ধ্বংস হোক নিপাত যাক’, ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’ ইত্যাদি।
এক রাতে তেমনি এক মিছিল বেরোল পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকা থেকে। সে মিছিলেও সবার আগে হাড্ডি খিজির। মিছিল এগোচ্ছে নবাবপুরের দিকে। হঠাৎ দানবের মতো ছুটে আসে মিলিটারির ট্রাক। এসেই ছুড়তে শুরু করে এলোপাতাড়ি গুলি। বুলেটবিদ্ধ হাড্ডি খিজির লুটিয়ে পড়ে বাহাদুর শাহ পার্কসংলগ্ন ফুটপাতে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে উচ্চকিত এক প্রতিবাদী যুবক। রক্তভেজা ফুটপাতে পড়ে থাকে হাড্ডি খিজিরের নিষ্প্রাণ দেহ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হাড্ডি খিজিরের শেষ পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—‘ভোর না হতেই তিনটি বড় মাছি খিজিরের হাঁ করা মুখের ওপর ভোঁ ভোঁ করে ওড়ে। কিছুক্ষণ পর ওদের নীল পাখায় গোলাপী আভা পড়ে তেরছা হয়ে।...কিন্তু ভালো করে রোদ ওঠার আগেই মিলিটারির গাড়ি এসে দেখতে দেখতে সব লাশ তুলে নেয়। শেষ লাশটি ছিল খিজিরের।’ (পৃষ্ঠা; ২৭৭, প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ; অক্টোবর ১৯৯৫, ইউপিএল)।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে হাড্ডি খিজিরের বর্ণনা দিয়েছেন, এমন অসংখ্য হাড্ডি খিজিরের অস্তিত্ব মিশে আছে আমাদের ইতিহাসে। তারা আমাদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনতে অসামান্য অবদান রেখেছে। কখনো আবার সে বিজয় আনতে গিয়ে দিয়েছে প্রাণ। আন্দোলন চলাকালে তাদের লাশ নিয়ে মিছিল হয়েছে, কখনোবা হয়েছে গায়েবানা জানাজা। অসংখ্য মানুষ স্লোগান তুলেছে, ‘অমুক ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’। কখনোবা ওয়াদা করেছে, শহীদ ভাইদের আমরা ভুলব না। কিন্তু দু-চারজন ভাগ্যবান শহীদ ছাড়া আর কারও কথা কেউ মনে রাখেনি। এমনকি কোন আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই আমাদের কাছে। ইতিহাসে স্থান পাওয়া কয়েকজন ছাড়া বাকিরা পরিণত হয়েছেন ‘নাম না জানা শত শহীদে’। তাদের নামে বিশেষ বিশেষ দিবসে আমরা শপথ নিই—‘যে স্বপ্ন চোখে মেখে তারা আত্মদান করে গেছেন, সে স্বপ্নকে আমরা সার্থক করবই।’ ব্যস, ওই একদিনই। তারপর আর কারও সে কথা মনে থাকে না।
১০ নভেম্বর ছিল শহীদ নূর হোসেন দিবস। এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক শোকাবহ অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৮৭ সালের এদিনে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিল স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে। স্বৈরশাসন হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ছিল তাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেদিন সে বিক্ষোভে যুবলীগকর্মী নূর হোসেন শামিল হয়েছিলেন বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে এক জীবন্ত পোস্টার হয়ে। স্বৈরশাসকের পুলিশ বাহিনীর বুলেট নিমিষেই ঝাঁজরা করে দিয়েছিল সেই বুক, জীবন্ত পোস্টারটি লুটিয়ে পড়েছিল রাজপথে। নূর হোসেনের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘বুক তাঁর বাংলাদেশের হৃদয়’। কবি শামসুর রাহমান নূর হোসেনের বুককে বাংলাদেশের হৃদয় বলেছেন; যে বুকে ছিল গণতন্ত্রের জন্য আকুতি। নূর হোসেন কিন্তু জানতেন না এরশাদের পতন হলে কে কে মন্ত্রী-এমপি হবেন। তার প্রত্যাশা ছিল একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যদি প্রশ্ন করা হয়, শহীদ নূর হোসেনের সে স্বপ্ন কি সার্থক হয়েছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বড্ড কঠিন। নূর হোসেনের আত্মত্যাগের মাত্র তিন বছরের মাথায় পতন ঘটেছিল স্বৈরশাসক এরশাদের। তারপর নূর হোসেনের দল এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের সহযাত্রী রাজনৈতিক দলটি বারবার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু নূর হোসেনের আকাঙ্ক্ষা গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে? স্বৈরাচার কি নিপাত হয়েছে? এসব প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়ার কেউ আছেন বলে মনে হয় না। কেননা, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দুই সারথি রাজনৈতিক দল যারা যখন ক্ষমতায় গেছে, মনোযোগ দিয়েছে ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে। নূর হোসেনসহ শত শহীদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে সংহত করার চিন্তা তাদের মাথায় আর থাকেনি।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল, যে স্বৈরাচারকে তারা সম্মিলিত আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল, ক্ষমতার মসনদকে সংহত করতে সেই স্বৈরাচারকে কোলে তুলে নিতে তারা এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। যে স্বৈরাচার নূর হোসেনসহ শত শত গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্দয়ভাবে খুন করেছে, সেই স্বৈরাচারকে পাশে বসিয়ে কি শহীদেদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব? রাজনৈতিক দলগুলোর এ আচরণকে দ্বিচারিতা বললে অত্যুক্তি হবে না। আর সেজন্য দেখা গেল, ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠনের পথ নিষ্কণ্টক করতে আওয়ামী লীগ পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে পার্টনার করে নিল। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সখ্য লুকোছাপার বিষয় ছিল না। জাতীয় ঐকমত্যের নামে এ দুই দলের প্রেমলীলা ছিল বড়ই উপভোগ্য। অভিনব সব ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে। ক্ষমতার রাজনীতির ভোজবাজি খেলায় জাতীয় পার্টি গাছেরটা খেয়েছে, তলারটাও কুড়িয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে একই সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দলের সরকারের অংশীদার ও সংসদে বিরোধী দল হওয়ার নজিরবিহীন নজির। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক অভিনব ঘটনাই ঘটে। তবে জাতীয় পার্টির একই সঙ্গে সরকার ও বিরোধী দল হওয়া ছিল অভিনবত্বে বিশ্বরেকর্ড।
আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রেমলীলার শুরু হয়েছিল গোড়া থেকেই। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাতের অন্ধকারে প্রাগৈতিহাসিক ডাকাতের মতো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বয়োবৃদ্ধ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন ‘আই অ্যাম নট আনহ্যাপি’। অর্থাৎ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি ও তার সরকারকে উৎখাতের ঘটনায় শেখ হাসিনা ‘অখুশি’ ছিলেন না। তার মানে তিনি ও তার দল খুশি হয়েছিল। এটা ছিল নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের শামিল। কেননা, এরশাদ বিএনপি সরকারকে উৎখাত করলেও পরিণামে তিনি দেশ থেকে গণতন্ত্রকেই উৎখাত করেছিলেন; যার বিষময় ফল শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকেও ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত শেখ ফজলুল করিম সেলিম সম্পাদিত ও মালিকানাধীন অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার বাণী এরশাদের ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকে সমর্থন করায় এরশাদ সবসময় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের প্রতি কৃতজ্ঞ থেকেছেন। যে কারণে ১৯৮৬ সালের মে মাসে এরশাদ ঘোষিত সংসদ নির্বাচন সব দল সম্মিলিতভাবে বর্জন করা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়ে অবৈধ সরকারকে বৈধতা দেন এবং নিশ্চিত পতন থেকে এরশাদকে রক্ষা করেন। অনেকেই বলে থাকেন, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এ প্রেমবন্ধনের প্রধান কারণ দুটি দলের শক্তির উৎসবিন্দু এক। যে কারণে আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির বর্জনের মুখে এরশাদকে অংশ নিতে বাধ্য করার জন্য নিকট প্রতিবেশী দেশটির স্বরাষ্ট্র সচিব ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশে। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এমন ন্যাংটা হস্তক্ষেপ সচরাচর দেখা যায় না। ক্ষমতায় যেতে এবং টিকে থাকতে উদগ্র একটি রাজনৈতিক দল তাদের দলের একজন হতভাগ্য কর্মীর রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলাবে, তা বিস্ময়কর নয়।
অন্যদিকে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন সংগ্রামী দল বিএনপিও কোনো ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেনি। স্মরণযোগ্য, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ৯ বছর রাজপথে আপসহীন ভূমিকা পালন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছেন। সেই আপসহীন নেত্রীর দল বিএনপিকেও দেখা গেছে এরশাদকে বগলদাবা করার জন্য তার হাত ধরে টানাটানি করতে। স্মরণ থাকার কথা, পরবর্তী নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতার লক্ষ্যে ২০০৬ সালে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমান তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সমভিব্যহারে এরশাদের বাসভবনে ছুটে গিয়েছিলেন। বিএনপির এ ভূমিকা দলটির সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের আহত করলেও কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। তবে অনেকেই মন্তব্য করেছিলেন, বিএনপি যতই চেষ্টা করুক, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভালোবাসার বন্ধনে ফাটল ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। এরশাদ তথা জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের ছায়া থেকে দূরে থাকতে পারেনি। কখনো কখনো দূরত্ব সৃষ্টি হলেও আওয়ামী লীগ ‘আয় আয় তু তু’ বলে ডাকলেই প্রভুভক্ত একটি জীবের মতো লেজ নাড়তে নাড়তে দৌড়ে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কথায় মানুষ আন্দোলনে নামে, রাজপথে স্লোগান দেয়। পুলিশ মিলিটারির গুলি খায়। মিছিলের ওই মানুষগুলোর কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ থাকে না। কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়—‘কেউ আসে মিছিলে সাজিয়ে বা সাজাতে সংসার, কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার।’ এ সংসার জ্বালানো মানুষগুলোর রক্তের স্রোতে বেয়েই আসে রাজনৈতিক পরিবর্তন। কিন্তু তারা সে পরিবর্তনের সুফল পায় না। তাদের নিষ্প্রাণ দেহের ওপর উড়ে বেড়ায় মাছি। সেটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সৃষ্ট চরিত্র হাড্ডি খিজিরের যেমন; নূর হোসেন, জেহাদ, ডা. মিলনেরও তেমনি। কেউ আর তাদের কথা মনে রাখে না। স্বপ্ন বাস্তবায়ন তো দূরের কথা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক