ভিন্নমত—তা বিরোধী রাজনৈতিক দলের হোক কিংবা নেহাত সরকারের একজন সমালোচক, শাসন ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে গুম করে দেওয়ার ঘটনাই স্পষ্ট করে যে, সেই রাষ্ট্রে শাসকশ্রেণির অত্যাচার, দমনপীড়নের অন্যান্য চিত্র কেমন হতে পারে। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া বাংলাদেশেই এমন ঘটনার শিকার ও সাক্ষী হতে হয়েছে এ দেশের মানুষের; বিশেষ করে গত প্রায় দেড় যুগে।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার মানুষ গুমের শিকার হন—এমনটাই ধারণা করছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। এসব মানুষের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা করছে কমিশন। গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে এসব তথ্য অবহিত করেন কমিশনের সদস্যরা।
চলতি বছর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের তিন দিন পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ও দলীয়করণে ধ্বংস হয়। সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিঃশেষ করা হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চর্চার বদলে গড়ে তোলা হয় একনায়ক বা স্বৈরশাসন ব্যবস্থা। দূরে সরে যাওয়া হয় জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার পথ থেকে। ভুলিয়ে দেওয়া হয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। এসব প্রক্রিয়ায় যেসব দমনপীড়নের পথ অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও অমানবিক পথ ছিল গুম। গুমের শিকার এসব মানুষ ‘আয়নাঘর’ নামক টর্চার সেলে নিদারুণ নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচারের শিকার হন। তারা অনেকেই মারা যান। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয় অনেককে। বিরাট একটি সংখ্যার মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়নি বা কোনো হদিস নেই আজও! আবার কেউ কেউ ছাড়া পেয়েছেন জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের কল্যাণে। গুম জীবনে তাদের ওপর চলা অমানুষিক নির্যাতনের রোমহর্ষক বর্ণনা তারা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দেন।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের পর গুমসহ বিগত সরকারের দুঃশাসনের সব দিক ধীরে ধীরে সামনে আসতে শুরু করে। একপর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকার সামগ্রিক রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দেয়। এ কাজে গুমবিষয়ক কমিশনসহ অনেক কমিশন গঠন করা হয়। সব কমিশনের কাজ এখন চলমান। তারই অংশ হিসেবে শনিবার গুম কমিশনের সঙ্গে সভা হয়। সভায় জানা যায়, ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতেই গুমসংক্রান্ত পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দিতে পারবেন এ কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান জানান, তারা গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ১ হাজার ৬০০ অভিযোগ পেয়েছেন। তার মধ্যে ৪০০ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। অভিযোগকারীদের মধ্যে ১৪০ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। অভিযোগকারীদের বক্তব্যে কমিশন সন্তুষ্ট। তবে অনেকে এখনো কমিশনে আসেননি। কমিশনের একজন সদস্য জানান, কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে। কারা গুমের নির্দেশদাতা, তাদেরও খোঁজা হচ্ছে। তার ভাষ্যে, গুমের শিকার অনেকে এখনো কারাগারে। কারও কারও কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। গুমের ঘটনায় দায়ীদের শনাক্ত ও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে কমিশনকে সব ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধান উপদেষ্টা।
আমাদের প্রত্যাশা, গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে, যেন ভবিষ্যতে কোনো রাষ্ট্রপরিচালক একই পথে হাঁটার সাহস না করে।