কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৯ এএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কালবেলা বিশেষ সাক্ষাৎকার

সংস্কারের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভেঙে জনতার রাষ্ট্র গঠন

সংস্কারের লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভেঙে জনতার রাষ্ট্র গঠন

ড. বদিউল আলম মজুমদার অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি ফেডারেল ফ্যাকাল্টি ফেলো হিসেবে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’র প্রধান কার্যালয় ওয়াশিংটন ডিসিতে যোগদান করেন। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বর্তমান পর্যায়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দায়িত্বে আছেন ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও। এ ছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, গত সরকারের কার্যক্রম, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাস্তবতা, রাজনীতি ও রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি

কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এ অভ্যুত্থান আমাদের জন্য কী বার্তা দেয়?

বদিউল আলম মজুমদার: বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের সম্পৃক্ততায় যে বিপ্লব ঘটেছে, তা দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব ঘটনা। এ বিপ্লবের মাধ্যমে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে এবং ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এ গণঅভ্যুত্থান অনেকগুলো বার্তা দেয়। তবে সবচেয়ে বড় দুটি বার্তা হলো দেশে বিচার এবং সুশাসন নিশ্চিত করা।

গত ১৫ বছরে দেশে বহু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে, অর্থনৈতিক অপরাধ হয়েছে এবং সর্বোপরি নির্বাচনী অপরাধ হয়েছে। দেশের মানুষ এসব অপরাধের এবং এ অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার চায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিগত ১৫ বছরে দেশে হাজার হাজার মানুষ খুন ও গুমের শিকার হয়েছেন। শুধু এই জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলনে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যার শিকার হয়েছে। ৩০ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। বহু মানুষ অঙ্গহানি হয়েছে, কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, কেউ হারিয়েছে চোখ। এই নৃশংসতার বিচার হওয়া দরকার। আওয়ামী লীগের শাসনের গত ১৫ বছরে দেশে অনেক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে, নানাভাবে মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। দেশে ভয়াবহ মাত্রায় দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, লুটপাট ও পুঁজি পাচার হয়েছে। মূল্যস্ফীতিসহ অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে দরিদ্র মানুষের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়া হয়েছে। যারা এত এত সব অপরাধ ঘটিয়েছে, তাদের বিচার হওয়া দরকার এবং কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার।

গত তিনটি নির্বাচনে যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অনেকেই এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে দলীয় নেতাকর্মী পর্যন্ত নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত লাখ লাখ মানুষ দেশের তিনটি জাতীয় নির্বাচন লুট করার অপরাধ করেছেন। তারা দেশের মানুষের অধিকার হরণ করেছেন। নির্বাচনী নীতিমালায় এ অপরাধে তাদের প্রত্যেকের দুই থেকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হওয়ার কথা। কিন্তু কারোরই কোনো বিচার হয়নি। কেউ শাস্তি পায়নি। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য হলেও এসব অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি দাঁড় করানো জরুরি। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে এসব অপরাধের বিচারের আকাঙ্ক্ষা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।

এই গণঅভ্যুত্থান থেকে আমরা রাষ্ট্র মেরামতের বার্তা পেয়েছি। এমনকি রাষ্ট্র মেরামতের দাবি উঠেছে আমাদের শিশুসন্তানদের থেকেও। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছোট ছোট বাচ্চারাই রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছে। এ শিশুরাই বড় হয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তাদের এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত একদফা আন্দোলনের এবং ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে।

কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠেছে। আপনার মন্তব্য কী?

বদিউল আলম মজুমদার: রাষ্ট্র মেরামত বলতে আমরা বুঝি রাষ্ট্রের খোলনলচে পরিবর্তন। রাষ্ট্র যেভাবে দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে, যেভাবে একটি ক্রিমিনাল এম্পায়ার সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটার থেকে মুক্তির প্রক্রিয়াটাই হলো রাষ্ট্র সংস্কার। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়েই এ সংস্কারের যাত্রা হতে পারে। আর এ রাস্তায় প্রথম প্রয়োজন সংবিধানের সংস্কার। একই সঙ্গে নির্বাচনী আইনকানুনের সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্কারসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সংস্কার প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে দেশের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা বলেছিলেন। আরও অনেক কমিশন গঠন করা হয়েছে। এ কমিশনগুলোর দেওয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। আর এ সংস্কার প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হলো, ফ্যাসিবাদী সরকারের রেখে যাওয়া ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা এবং ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে ভেঙে দিয়ে একটি জনগণের রাষ্ট্র গঠন করা। অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে এমনভাবে সংস্কার করতে চায়, যাতে ভবিষ্যতে আবারও এখানে স্বৈরাচার গেড়ে বসতে না পারে।

কালবেলা: অনেকে বলছেন রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রথমে প্রয়োজন রাজনীতির সংস্কার। রাজনৈতিক দলগুলোই ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। সে ক্ষেত্রে রাজনীতিতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার: এ দেশে সংস্কার বা পরিবর্তনের কথা আজই প্রথম উচ্চারিত হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্র সংস্কারের এ দাবি বা আলোচনা অনেক পুরোনো। এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধও ছিল সংস্কার প্রত্যাশারই ফল। সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার মতো কতগুলো সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়েই বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণ দেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখায়ও কতগুলো সুস্পষ্ট সংস্কারের অঙ্গীকার ছিল। সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো সেসব সংস্কার প্রস্তাব থেকে যোজন যোজন দূরে রয়েছে। আমি এ ক্ষেত্রে অনেকবার বলেছি, আমরা পথ হারানোর জাতিতে পরিণত হয়েছি।

২০০৭-০৮ সালেও কতগুলো সংস্কারের সুস্পষ্ট রূপরেখা উত্থাপন করা হয়। তখন সংস্কার কথাটি একধরনের গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমরা যারা সংস্কার চেয়েছি তাদের সংস্কারবাদী হিসেবে হেয়প্রতিপন্ন করা হয় এবং নানাভাবে সমালোচনা করা হয়। এমনকি একটি জাতীয় পত্রিকা হেডলাইন করেছিল যে, ‘এরা রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার চায়’। তারা বোঝাতে চেয়েছিল, রাজনৈতিক দল যেভাবে চালাবে মানুষ সেভাবে চলবে। সেখানে সংস্কারের কথা বলার আমরা কে! কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের সেই সংস্কার প্রস্তাবগুলো যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে আজকে এ পরিস্থিতিতে আমরা পড়তাম না। অতীতে আমাদের অনেক সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে, এমনকি বাস্তবায়নের চেষ্টাও হয়েছে কিন্তু দিনশেষে সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো যখন ক্ষমতায় গেছে তখন তারা এসব সংস্কার থেকে দূরে সরে গেছে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর সেই কাজেরই মাশুল আমরা এখন দিচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও দেব। এখন এই উদ্ভূত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের সামনে একটাই পথ রয়েছে। সেটা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কারের উপলব্ধি তৈরি হওয়া। অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করা সংস্কার কাজগুলো যদি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসেও চলমান রাখে, তাহলেই কেবল এ গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ণতা পাবে। শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন কারণ তিনি একটি দানবীয় কাঠামো নিজের মতো ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছেন। এ দানবীয় কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণের সুযোগই তাকে দানবে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন যদি উপলব্ধি না আসে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু করে যাওয়া সংস্কার কাজগুলো যদি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে আবারও এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা হবে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো। এমন যে, তারা সবকিছুকে নষ্ট করে যত ময়লা-আবর্জনা সৃষ্টি করেছে, তা পরিচ্ছন্ন করার রাস্তা খোঁজার দায়িত্ব পড়বে আমাদের ঘাড়ে। এখানে মূল বিষয়টা হলো, আমরা শুধু কীভাবে পরিচ্ছন্ন করতে হবে সেই রাস্তাটা প্রস্তাব ও পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু সেই প্রস্তাব বা পরামর্শ বাস্তবায়ন করার মূল দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই। কিন্তু তারা যদি সেই পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলমান না রাখে তাহলে এ ময়লা-আবর্জনার স্তূপ আরও বড় হবে। এমনও ঘটতে পারে, বাংলাদেশ আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাবে।

কালবেলা: আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ না করলে বা আওয়ামী লীগকে ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করেন?

বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন মানেই হলো বিকল্পগুলোর মধ্যে থেকে একটি দলকে বেছে নেওয়া। অর্থাৎ বিকল্প থাকতেই হবে এবং তা হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প। দেশে যখন একের পর এক একতরফা নির্বাচন হয়েছে, তখন আমরা এ সমালোচনাটাই করেছি। গত ৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ যে নির্বাচন করেছে, সেখানে তারা সব রকমভাবে চেষ্টা করেছে যাতে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে। নির্বাচনের নামে একটি সাজানো নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এর আগের দুটি নির্বাচনও একইভাবে একতরফা এবং লোকদেখানো নির্বাচন ছিল।

এবার আসি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে। আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ যেমনটা করেছে, যেভাবে বিরোধী দলগুলোকে হামলা-মামলা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে ঠেকিয়েছে; এ অন্তর্বর্তী সরকার তেমনটা করবে কল্পনাও করা যায় না। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ রাখবে। সুতরাং এরপরও কোনো দল যদি নিজেদের সংগঠিত করতে না পারে, তারা যদি দল গোছাতে না পারে এবং নির্বাচনের অংশগ্রহণ না করতে পারে; তখন কি মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা সমীচীন হবে? আমি মনে করি সেটা ঠিক হবে না। সুতরাং কোনো দলের একান্তই নিজের ব্যর্থতার জন্য নির্বাচন আটকে থাকবে না।

এই দেশের তরুণ প্রজন্ম যাদের বয়স ৩০ বছর পার হয়ে গেছে তারা জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। তারা আর কতদিন ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবে? ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারল কি পারল না তাতে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কিছুই করার থাকবে না। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ না নেয় তবুও নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না।

কালবেলা: আপনি দীর্ঘকাল ধরে সুশাসনের জন্য আন্দোলন করছেন। আপনার মতে, বাংলাদেশের সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী?

বদিউল আলম মজুমদার: বাংলাদেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ত্রুটিপূর্ণ রাজনীতি। বাংলাদেশে যে রাজনীতি চর্চা করা হয় সেটা আসলে কোনো রাজনীতি নয় বরং অপরাধনীতি। এখানে রাজনীতি মানুষকে কল্যাণে নয় বরং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কল্যাণে পরিচালিত হয়। আমরা যদি এ রাজনীতিকে জনসেবা হিসেবে ধরি, তাহলে সুশাসনের সামনের সবচেয়ে বড় বাধাটি দূর হয়ে যাবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক যাত্রা হয় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আর সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় দুই নির্বাচনের মাঝখানে। যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় তারা যদি কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন, তারা যদি মানবাধিকার সংরক্ষণ করে, তারা যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে, তারা যদি ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তারা যদি স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে এবং তারা যদি দেশ শাসনে মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে; তাহলে সেই সরকারই সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার। আর সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং আমি আশা করি, যারাই পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসবে এবং সরকার গঠন করবে, তারা আমাদের জুলাই-আগস্টের এ মর্মান্তিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ এবং কার্যক্রমে পরিবর্তন আনবে।

রাজনৈতিক দলগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে যে, তাদের আগের চেয়ে এখন আরও ভালো কিছু করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা অতীতে যা করেছে ভবিষ্যতে যদি আবারও তাই করে তাহলে এর পরিণতি হবে খুবই মর্মান্তিক ও ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা যে মাশুল দিচ্ছে, সেটা থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও শিক্ষা নেওয়া উচিত।

কালবেলা: আপনি নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন। কী সংস্কার করবেন?

বদিউল আলম মজুমদার: প্রথমত এই গুরু দায়িত্বটি আমাকে দেওয়া হয়েছে, এতে আমি সম্মানিত বোধ করছি। একই সঙ্গে এটি আমার এবং আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, আমাদের সবার জন্য একটি বড় স্বীকৃতি। সুতরাং আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা সত্যি যে, আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাটি একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এ লাইনচ্যুত নির্বাচনী ব্যবস্থা আবার কীভাবে লাইনে তোলা যায় সেই দায়িত্বটি আমাদের ওপর অর্পিত হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য আমাদের কতগুলো পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে এবং কিছু আইনের সংস্কার করতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে যে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো রয়েছে, সেগুলো দূর করতে হবে। একই সঙ্গে এখানে কিছু কিছু নতুন ধ্যানধারণার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এসব কিছুর মাধ্যমে আশা করছি আমরা একটি সুপারিশমালা তৈরি করব এবং কিছু আইনের খসড়া তৈরি করব, যা বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার কার্যকর সংস্কার সাধন করতে পারবে। আমরা এ সুপারিশগুলো সরকারের কাছে দেব। এরপর সরকার এ সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করে ঐকমত্যে পৌঁছবে।

আমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব, অতীতে যারা নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মতামত নেব, গণমাধ্যমগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করব, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও মতবিনিময় করার চেষ্টা করব। আমরা আশা করব, যে সুপারিশমালাগুলো আমরা প্রণয়ন করব সরকার সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে তার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছবে।

কালবেলা: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ এখন বলছে সংস্কারের অধিকার অন্তর্বর্তী সরকারের বা আপনাদের নেই। সংস্কার করবে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

বদিউল আলম মজুমদার: তাদের এ দাবিগুলো সঠিক নয়। তারা যদি মনে করে অন্তর্বর্তী সরকারের বা আমাদের সংস্কার করার কোনো অধিকার নেই, তাহলে বলব তারা ভুলের মধ্যে রয়েছে। আমরা এই গণঅভ্যুত্থানের অংশীদার। আর সবচেয়ে বড় আইন হলো, ‘আমরা জনগণকে ভালোবাসি’। এটাই সবচেয়ে বড় লেজিটিমেসি। দেশের জনসাধারণ চায় দুর্বৃত্তদের বিচার হোক। জনসাধারণ চায় এ রাষ্ট্রের মেরামত হোক। জনগণ চায় যাতে দেশে আবার কোনো ফ্যাসিস্ট শক্তি প্রতিষ্ঠিত না হয় এবং জুলাই-আগস্টের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। আমরা পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো রাষ্ট্র পরিচ্ছন্নতার দায়িত্ব পেয়েছি। জনগণ আমাদের এ দায়িত্ব দিয়েছে। সুতরাং রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ করে জনগণের দেওয়া দায়িত্ব সম্পন্ন করাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। কেউ যদি মনে করেন বা বলেন যে, আমাদের রাষ্ট্র সংস্কার করার কোনো এখতিয়ার নেই তাহলে তারা এই গণঅভ্যুত্থান অস্বীকার করছেন। এ গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল যেন এমন পরিস্থিতির আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সুতরাং আমি মনে করি, জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমরা যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, সেটাতে তারা সর্বোত্তম সহযোগিতা করবেন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিলামের আগে আইপিএলের দলগুলোকে যে বার্তা দিল বিসিবি

বগুড়ায় অস্ত্রসহ কৃষক লীগ নেতা গ্রেপ্তার

রংপুরে বীজ আলুর সংকট, দিশাহারা কৃষক

সব যোগ্যতা থাকার পরও জিয়ার নাম থাকায় মেলেনি এমপিও

অতিরিক্ত ওজন কমাবে শীতের যেসব সবজি

জুরাইন রণক্ষেত্র, অবরোধকারীদের কয়েকজন আটক

রাশিয়া শান্তি চায় না, এবার জবাব দিতে হবে : বিশ্বকে জেলেনস্কি

মাছ ধরার নৌকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিনের ধাক্কা

বেঁচে ফিরব আশা ক‌রিনি

পানের বরজে গাঁজা গাছ

১০

ব্যাংককে রাফসান-জেফার, উড়ো প্রেমের গুঞ্জন (ভিডিও)

১১

জনবল নিয়োগ নিচ্ছে নিটল মটরস, কর্মস্থল ঢাকায়

১২

পাত্র খুঁজছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী মেহউইশ হায়াত (ভিডিও)

১৩

ঢাকায় পৌঁছেছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

১৪

৪২ টাকায় কেনা কলার চিত্রকর্ম ৭২ কোটিতে বিক্রি

১৫

এবার অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নারী বেছে নিলেন ট্রাম্প

১৬

ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা পার

১৭

বিচ্ছেদের পর এই প্রথম এআর রহমানের পোস্ট

১৮

লঘুচাপের শঙ্কা, এরপরই জেঁকে বসবে শীত

১৯

রংপুর জিলা স্কুল মাঠ নয়, মাহিগঞ্জ কলেজে হচ্ছে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ

২০
X