আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক মহলের নজরের কেন্দ্রে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। মার্কিন প্রাক-নির্বাচনী দলও আসছে। এর আগেও একাধিক মার্কিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এ ছাড়া অন্য অনেক দেশও বাংলাদেশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে। সবাই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অটল। এটা বাংলাদেশের জনগণেরও আকাঙ্ক্ষা। মজার কথা হলো, বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলও এ আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে একমত। পদ্ধতি নিয়ে দ্বিমত থাকলেও আকাঙ্ক্ষায় কারও কোনো ভিন্নমত নেই। সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমরা নিজেরা মিলে আলোচনায় এ অভিন্ন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে অভিন্ন রূপরেখা প্রণয়ন করতে পারতাম। কিন্তু বিএনপি মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। আর আওয়ামী লীগ সংবিধানের আওতায় বিদ্যমান ব্যবস্থায়ই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করছে। দুই দলের এ অনড় অবস্থাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিদেশি হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ আমাদের জন্য লজ্জার। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতাই বিদেশিদের ডেকে এনেছে। যতই লজ্জার হোক, বিদেশিদের পরামর্শ মেনে নেওয়া ছাড়া এখন আর আমাদের কোনো উপায় নেই। একসময় টিভিতে একটা বিজ্ঞাপনে বলা হতো, ‘দাগ থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তবে তো দাগই ভালো।’ বিদেশি হস্তক্ষেপ যদি আমাদের অচলাবস্থা দূর করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ সুগম করতে পারে, তাতে এ হস্তক্ষেপ মানতে আমাদের আপত্তি নেই। এরই মধ্যে বিদেশি হস্তক্ষেপের কিছু ইতিবাচক প্রভাব আমরা দেখেছি। র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর বদলে গেছে মাঠের চিত্রও। আওয়ামী লীগ সরকার এখন আগের মতো মারমুখী নয়। বিএনপিও আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বিদেশিদের হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে এই কলামে লিখেছিলাম, ‘আওয়ামী লীগ চাপে, বিএনপি বিপাকে’। সেই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি এখনো। তবে চাপে পড়ার কথা বা বিপাকে থাকার কথা কেউই স্বীকার করছে না। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের চাপে বিএনপি প্রাথমিকভাবে উৎফুল্ল হলেও যতই দিন যাচ্ছে, ততই তাদের উচ্ছ্বাস কমে আসছে। বিদেশিরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বললেও তারা কেউই অংশগ্রহণমূলক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে মুখ খুলছে না। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই তাদের লক্ষ্য। যতই হস্তক্ষেপ করুক, কোনো দেশই আরেক দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বাইরে কিছু বলতে পারে না। তাদের দায়িত্ব অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা। সে জন্য নজরদারি বাড়ানো, প্রয়োজনে নানামুখী চাপ দেওয়া। বিএনপি বারবার বলছে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের দাবি, ২০১৮ সালে সরকারের আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা প্রতারিত হয়েছে। তবে ২০১৮ সালের পরিস্থিতি আর ২০২৩ সালের পরিস্থিতি এক নয়। এখন বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার দিকে সবার নজর। নির্বাচনের আগেই যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী চাপ দিচ্ছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হলে নিশ্চয়ই দায়ীদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতি প্রয়োগ করবে। প্রয়োজনে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। তাই চাইলেও আওয়ামী লীগ আগের মতো প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের ঝুঁকি নেবে না। তবে বিদেশিদের তৎপরতায় বিএনপি আশ্বস্ত হতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং যতই দিন যাচ্ছে, বিএনপিকে একটু হতাশই মনে হচ্ছে। হতাশাটা লুকাননি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত কী বলল, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আন্তর্জাতিক বিশ্বের ওপর নয়, জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে বিএনপি। মির্জা ফখরুল মুখে যাই বলুন, এটা যে তার মনের কথা নয়; সেটা বুঝতে বিশ্লেষক হতে হয় না। জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করলে বিএনপি আরও আগেই আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করত। যে ২০১৮ সালে নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে এত সমালোচনা, সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধেও কিন্তু রাজপথে কার্যকর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আদালতে তারা নির্বাচনটিকে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারেনি। এখন বিএনপি বিদেশিদের তৎপরতার সঙ্গে মিলিয়েই নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন প্রতিনিধিরা যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখনই বিএনপি সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করেছে। কিন্তু বিদেশিদের প্রত্যাশিত সমর্থন না পেয়ে বিএনপির আন্দোলনে হতাশা ভর করেছে। ভিসা নীতির ভয়ে বিএনপি সহিংস আন্দোলনেও যেতে পারছে না, আবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকার পতনের মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি করতে পারছে না। বিএনপির আসলে এখন মরিয়া দশা।
মুখে স্বীকার না করলেও বিদেশিদের নানা তৎপরতায় প্রবল চাপের মুখে পড়েছে সরকার। র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতির প্রভাবের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। সরকার এখন বহুল সমালোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনও বদলে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার স্বীকার করুক আর নাই করুক, মার্কিন চাপের কারণেই যে ডিজিটাল নিরাপত্তা বদলানো হচ্ছে, তা বুঝতেও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। মার্কিন তৎপরতার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচনী স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলছেন। এরই অংশ হিসেবে গত সপ্তাহে তিনি প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা সেখানে তাকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিয়েছেন এবং দীর্ঘ মতবিনিময় করেছেন। বৈঠক শেষে পিটার হাস সাংবাদিকদের বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র; যেখানে কোনো পক্ষ থেকে সহিংসতা হবে না। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রত্যেকের ভূমিকা আছে। সরকার, গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ—প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগের এমন অবস্থান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়—বিএনপির এমন অবস্থান প্রসঙ্গে পিটার হাস বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অবস্থান নেই। এটি রাজনৈতিক দলের ব্যাপার। রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করবে। যুক্তরাষ্ট্র শুধু অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী।’ অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও ছিল অভিন্ন সুর। ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ ও নির্বাচন কমিশনের বিলুপ্তির বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। বিদেশিদের তৎপরতায় আওয়ামী লীগ কোনো চাপ অনুভব করছে কি না, এমন প্রশ্নে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ কেন চাপ অনুভব করবে? সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন আমাদের অঙ্গীকার। যদি বলেন, বিবেকের চাপ অনুভব করছি।’ একসময় যাত্রায় বিবেক নামে একটি চরিত্র থাকত। বাস্তবে বিবেকের কোনো কাঠামো নেই বটে, তবে অদৃশ্য বিবেকই একজন মানুষ থেকে আরেকজনকে আলাদা করে। সংবিধান, আইন, রেওয়াজের বাইরেও বিবেক মানুষকে সঠিক পথে চালিত করে। বিবেকের চাপটা কী, সেটার ব্যাখ্যা দেননি ওবায়দুল কাদের। তবে তিনি যদি ২০১৪ ও ‘১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ইঙ্গিত করে বিবেকের চাপের কথা বলে থাকেন; তাহলে মানতেই হবে আওয়ামী লীগের বোধোদয় হয়েছে। ২০১৪ সালে বিএনপি অংশ নেয়নি বলে সেবার আওয়ামী লীগের তেমন কিছু করার ছিল না। কিন্তু ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নেওয়ার পরও নির্বাচনের নামে যা হয়েছে, তা আসলে আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের জন্য লজ্জার। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও আড়ালে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে প্রশাসন বাড়াবাড়ি করেছে, যা দলের জন্য ভালো হয়নি। ওবায়দুল কাদের যদি ২০১৪ ও ’১৮ সালের নির্বাচনের গ্লানি মোচন করে বিবেকের চাপে একটি সত্যিকারের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করার কথা ভেবে থাকেন; তাহলে সেটা সবার জন্যই মঙ্গল।
লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মন্তব্য করুন