জলবায়ু পরিবর্তন বলতে প্রাকৃতিক কারণ (সূর্যের ক্রিয়াকলাপের পরিবর্তন এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত) বা মানুষের কার্যকলাপ (জীবাশ্ম জ্বালানির দহন) দ্বারা সৃষ্ট তাপমাত্রা এবং আবহাওয়ার উপাদানগুলোর বর্ধিত পরিবর্তনকে বোঝায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন পৃথিবীর চারপাশে একটি স্তর তৈরি করে, যা সূর্যের দ্বারা উৎপন্ন তাপকে আটকে রাখে, যার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৮০০-এর দশকের শেষের তুলনায় প্রায় ১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে এটি গত এক লাখ বছরের তুলনায় বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলস্বরূপ, কৃষি ফসল আবহাওয়ার উপাদান (লবণাক্ততা, খরা, বন্যা, তাপ ও ঠান্ডা) এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে। আমাদের খাদ্য, জ্বালানি, বাসস্থান, বস্ত্রের প্রধান উৎস হচ্ছে ফসল। একটি সূত্র নিরূপণ করেছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯.৬ বিলিয়নে পৌঁছাবে এবং ফসলের চাহিদা প্রায় ১০০-১১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ এবং প্রজননকে প্রভাবিত করছে। উচ্চ তাপমাত্রা ফসলের সালোকসংশ্লেষণ এবং প্রজনন প্রক্রিয়া (বিশেষ করে ফুল ফোটা ও দানা ভরণ পর্যায়ে) ব্যাহত করে উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য যেমন—ধান, গম ও ভুট্টাতে ফুল ফোটা এবং দানা ভরণ পর্যায়ে উচ্চ তাপমাত্রা ফসলের স্পাইকলেট বন্ধ্যা করে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি হুমকি হলো খরা। বাংলাদেশের প্রধান খরাপ্রবণ এলাকা হলো রাজশাহী (বরেন্দ্র ভূমি), রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁ এবং জয়পুরহাট জেলা। এ অঞ্চলগুলো উচ্চ তাপমাত্রা, সীমিত সেচ এবং কম বৃষ্টিপাতের কারণে ঘন ঘন খরার ঝুঁকি রয়েছে এবং দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ কৃষিজমি এ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। খরার প্রভাব গাছের বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রায় সব পর্যায়েই পড়ে কিন্তু ফুল ফোটার পর্যায় সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষি উৎপাদন কমিয়ে দেয়। মাটির লবণাক্ততা উপকূলীয় এবং উপকূলীয় জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য আরেকটি হুমকি, যা ঘন ঘন উচ্চ জোয়ারে লবণাক্ত সমুদ্রের জলে প্লাবিত হয়। বাংলাদেশের প্রধান লবণাক্ততাপ্রবণ এলাকাগুলো হলো—খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাটি, পিরোজপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা এবং ভোলা। উপকূলীয় এলাকা বাংলাদেশের কৃষি জমির ২০ থেকে ৩০ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। লবণাক্ততার প্রভাবে গাছপালা মাটি থেকে পানি গ্রহণকে সীমিত করে এবং বীজের অঙ্কুরোদগম, উদ্ভিদের বৃদ্ধি থেকে প্রজননসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, যা শেষ পর্যন্ত ফসলের উৎপাদনকে হ্রাস করে। পোকামাকড় এবং রোগজীবাণুর প্রাদুর্ভাবও জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ১৯০০ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছয় ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই শতাব্দীতে ১ থেকে ২.৫ ফুট বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
এগুলো মোকাবিলা করার জন্য, আমাদের আবহাওয়ার উপাদানগুলো এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার প্রতিকূল প্রভাব সহনশীল/প্রতিরোধী ফসলের জাত তৈরি করতে হবে। প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন বা মলিকুলার জেনেটিক টুলস ব্যবহার করেও এটি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতিতে ফসলের জাত তৈরির প্রক্রিয়াটি একটু ধীরগতির। কিন্তু এই পদ্ধতির প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো দীর্ঘ প্রজননচক্র (শস্যের প্রজাতির ভেদে ১০-১৫ বছর) ও আবহাওয়ার উপাদানগুলো এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার প্রতিকূল প্রভাব সহনশীল/প্রতিরোধী জিনের উৎস হলো ফসলের ওয়াইল্ড ফর্ম/রিলেটিভস। সংকরায়ণের
(hybridization) মাধ্যমে ওয়াইল্ড ফর্ম/রিলেটিভস থেকে উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোতে আবহাওয়ার উপাদানগুলো এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার প্রতিকূল প্রভাব সহনশীল/প্রতিরোধী জিন স্থানান্তর প্রক্রিয়াটির সফলতা খুব কম। সুতরাং, শুধু প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজনন পদ্ধতি একটি সঠিক সমাধান হতে পারে না। ফসল যখন আবহাওয়ার উপাদান এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার প্রতিকূল প্রভাবে পড়ে, এটি তখন অভিযোজন (acclimation) এবং পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে (adaptation) চেষ্টা করে। অভিযোজন হলো একটি অস্থায়ী ও অ-উত্তরাধিকারযোগ্য (non-inheritable) সহনশীল প্রক্রিয়া। অন্যদিকে পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো হলো জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি উত্তরাধিকারযোগ্য (inheritable) স্থায়ী পরিবর্তন। আবহাওয়ার উপাদান এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছার নেতিবাচক প্রভাব সহনশীলতার জেনেটিক প্রক্রিয়াটি প্রতিকূল পরিবেশে-প্রতিক্রিয়াশীল জিনগুলোর নিয়ন্ত্রণের ওপর নির্ভর করে। হাই-থ্রুপুট জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং ফেনোটাইপিং প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে, প্রতিকূল পরিবেশ সহনশীলতার মতো জটিল বৈশিষ্ট্যগুলো শনাক্ত এবং নির্বাচন করা সহজ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য মলিকুলার জেনেটিক টুলসগুলো যেমন—ট্রান্সজেনিক প্রযুক্তি, জিনোম-এডিটিং, জিনোমিক সিলেকশন, মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেকশন (MAS) এবং মার্কার অ্যাসিস্টেড ব্যাকক্রসিং (MABC) ব্যবহার করা যেতে পারে। ট্রান্সজেনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন শস্যের জাতগুলোর জাত তৈরি এবং অনুমোদনের জন্য কঠোর বায়োসেফটি রেগুলেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা প্রক্রিয়াটিকে যথেষ্ট বিলম্বিত করে। এ ছাড়া, বেশ কয়েকটি দেশ জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম (GMO) ফসলগুলোকে খাদ্য/পশুখাদ্য হিসেবে তাদের দেশে অনুমোদন দিচ্ছে না। সম্প্রতি, আধুনিক জিনোম-এডিটিং প্রযুক্তি বিশেষ করে ‘ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস (CRISPR)-CRISPR-অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন (Cas)’-এর স্বাচ্ছন্দ্য, নির্ভুলতা এবং দক্ষতার কারণে কৃষিবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কারণ এটি উন্নত ফসলের বিকাশে নতুন একটি সম্ভাবনা। জিনোম-এডিটিংয়ের মাধ্যমে অন্য উৎস থেকে ট্রান্সজিন স্থানান্তর না করেও কাঙ্ক্ষিত/অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যের সংযোজন/অপসারণ করে ফসলের নতুন জাত তৈরি করা যায়। জিনোম-এডিটিংয়ের মাধ্যমে তৈরি নতুন জাতটিও প্রচলিত উদ্ভিদ প্রজননের মাধ্যমে তৈরি জাতের অনুরূপ। অতএব, জিনোম-এডিটিংয়ের মাধ্যমে তৈরি ফসলের নতুন জাতকেও নন-জিএমও (non-GMO) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ প্রযুক্তির প্রধান সুবিধা হলো ট্রান্সজিনমুক্ত এবং ফসলের নতুন জাত উন্নয়নের প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করে (১-৩ বছর)। জিনোম-এডিটিংয়ের মাধ্যমে উন্নত গুণাগুণসমৃদ্ধ অনেক ফসলের জাত এরই মধ্যে উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপান সর্বপ্রথম ‘গাবা টমেটো’কে (উচ্চ রক্তচাপ-হ্রাসকারী বৈশিষ্ট্যে সম্পন্ন) জিনোম-এডিটেড ফসল হিসেবে তাদের দেশ বাণিজ্যিকীকরণ করে। এ ছাড়া, কিছু অন্যান্য জিনোম-এডিটেড ফসল রয়েছে যেমন—ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট প্রতিরোধী ধানের জাত, পাউডারি মিলডিউ প্রতিরোধী গমের জাত এবং উচ্চ অলিক অ্যাসিড সম্পন্ন সয়াবিনের জাত।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার উপাদানগুলো এবং রোগ, পোকামাকড় ও আগাছা মোকাবিলায় বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য আমাদের আধুনিক জিনোম-এডিটিং প্রযুক্তিকে জরুরিভাবে গ্রহণ করতে হবে।
পরিশেষে এটা বলা যেতে পারে যে, আমাদের ফসলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করার জন্য জিনোম-এডিটিং প্রযুক্তিকে, জিনোমিক সিলেকশন, মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেকশন এবং মার্কার অ্যাসিস্টেড ব্যাকক্রসিং ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি। তাই সরকারকে এ ধরনের উচ্চপ্রযুক্তির গবেষণাকে পৃষ্ঠপোষকতা এবং যথাযথ অর্থায়ন নিশ্চিত করা উচিত।
লেখক: অধ্যাপক, জেনেটিকস এবং প্লান্ট ব্রিডিং বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা