শুক্রবার, ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৯ পৌষ ১৪৩১
খান এ মামুন
প্রকাশ : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৭ এএম
আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অর্থনীতিতে জিম্বাবুয়ের উপসর্গ

অর্থনীতিতে জিম্বাবুয়ের উপসর্গ

বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর সুদের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এমনকি আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের কাছাকাছি। গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে নগদ অর্থের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। তারা ঘোষণার চেয়ে অনেক বেশি সুদে গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করছে। এজন্য নতুন নতুন আকর্ষণীয় আর্থিক পণ্যের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। স্বল্প সময়ে মিলিয়নেয়ার, লাখপতি, কোটিপতি নানা অফার দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে। সরকারি দপ্তরগুলো থেকে আমানত সংগ্রহের ব্যাপক চেষ্টা চলছে। সরকারি ঋণ অব্যাহত থাকায় ব্যাংক খাতে টাকার চাহিদা আরও বাড়ছে। এ ছাড়া সুদের হারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদের হার দ্রুতগতিতে। কিছু ব্যাংক আমানতের ওপর ১৬-১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করছে। ফলে মানুষ নগদ টাকা নিয়ে ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে ঋণের সুদের হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের ঋণগ্রহীতার জন্যই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। উচ্চ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে দেশের একটি অংশ মধ্যবিত্ত থেকে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ ও আমানতের হারের ওপর একটি ক্যাপ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। সে অনুযায়ী তফসিলি ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণের হার ৯ শতাংশ এবং আমানতের হার ৬.০ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। এ কারণে ঋণের সুদের হার ছিল এক অঙ্কে। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে সরকার ঋণের সুদের হার বিষয়ে একটি ব্যবস্থা চালু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯ শতাংশ হারের সীমা তুলে নেয়। তারপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দ্বারা নির্ধারিত বেঞ্চমার্ক ঋণের হার পদ্ধতি ঘোষণা করে। সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার পর, সুদের হার অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুদের হার সবচেয়ে বেশি। এটা বাংলাদেশের মতো আমাদের উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক। সব মিলে এখন বাংলাদেশের সুদের হার আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের কাছাকাছি।

সাধারণভাবে সুদের হার বিভিন্ন উপায়ে অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে তিনটি ক্ষেত্রে—এর মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ দিক হলো, এটি ঋণের খরচ বাড়ায়। এ কারণে ঋণগ্রহীতারা/ ব্যবসায়ীরা খরচ কমায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। দ্বিতীয়টি হলো ব্যবসার জন্য ঋণের খরচ বৃদ্ধি পায়। শেষটা হচ্ছে বিনিয়োগ কমানো। অত্যধিক সুদের হার ঋণ গ্রহণ এবং বিনিয়োগের ওপর প্রভাবের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যখন সুদের হার কম হয়, ঋণ নেওয়া সস্তা হয়ে যায়। ব্যবসা ও ভোক্তাদের ঋণ নেওয়ার এবং নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনা বেশি তৈরি হয়। সুদের হার কম থাকলে ব্যবসা সম্প্রসারণে বিনিয়োগের জন্য অর্থের জোগান পেতে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন নতুন শিল্পের নতুন সরঞ্জাম কেনা, গাছপালা আপডেট করা বা আরও কর্মী নিয়োগ করা। বিপরীতভাবে উচ্চ সুদের হার অর্থনীতিতে নতুন শিল্প এবং কর্মসংস্থানে বাধা দিতে পারে।

গত এক বছরে প্রায় ৩০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ অতিরিক্ত সুদের হার। এ কারণে কিছু কারখানা খেলাপি হয়ে পড়েছে। ছোট ছোট ব্যবসায়ীও ঋণ নিতে পারছেন না। উচ্চ সুদের হারের কারণে ব্যবসা করার ব্যয় বহুগুণ বেড়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে নির্মাণ খাত, যা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে গত পাঁচ প্রান্তিকের মধ্যে বাংলাদেশ তার সর্বনিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি রেকর্ড করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক প্রকাশিত ত্রৈমাসিক তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে জিডিপি বেড়েছে ৩.৯১ শতাংশ। এক বছর আগে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে জিডিপি বেড়েছে ৫.৪২ শতাংশ। এটা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক খবর। জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিনে দিনে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে।

সুদের হার বৃদ্ধির কারণে এসএমই খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতি বিশেষ করে ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। নতুন ঋণ নিয়েও ব্যবসা করতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এই এসএমই খাতই অর্থনীতির প্রাণ। দেশের ব্যাংক খাতে চলমান তারল্য সংকট ছোট ছোট ব্যবসায়ীর জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে। প্রায় দুই বছর ধরে চলমান সংকট এখন আরও তীব্র হয়েছে। নতুন ঋণ দেওয়া তো দূরের কথা, কিছু ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এ অবস্থায় দেশের সিএসএমই খাত আর্থিক সংকটে রয়েছে। ব্যাংক ঋণের অভাবে এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কার্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও দৈনন্দিন পরিচালন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে।

অন্যদিকে উচ্চ সুদের হার ব্যাংক আমানতকে প্ররোচিত করে। কিছু ব্যাংক আমানতের ওপর ১৬-১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ প্রদান করে। সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক ঘোষণার চেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে। সরকারকে ঋণ প্রদান অব্যাহত থাকায় ব্যাংক খাতে তরল টাকার চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া সুদের হারের সীমাও তুলে নেওয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমানতের সুদের হারও বাড়ছে। তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো তুলনামূলক বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে। কিছু ব্যাংক আমানতের ওপর উচ্চ সুদ প্রদান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত ছিল ১৬ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি।

সাধারণভাবে অর্থ বা ঋণের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে সুদের হার বাড়বে, যখন ঋণের চাহিদা হ্রাস পেলে তা হ্রাস পাবে, এটি বিশ্বব্যাপী একটি সর্বস্বীকৃত একটি বিষয়। তাই বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়াতে হবে। এখন ৫০ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক তারল্য সংকটের মধ্যে রয়েছে। বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়ানো খুব কঠিন। এ কারণে সহজে সুদহার কমানোর কোনো লক্ষণই নেই। দেশের ব্যাংকের একটি বড় অংশ যেখানে টাকা সংকটে, সেখানে মানুষকে কীভাবে ঋণ দেবে?

সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশ কি আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের পথে হাঁটছে! দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান হেলেন সাজমান ফাউন্ডেশনের মতে, জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে থাকা, শিল্প উৎপাদন কমে আসা, শ্রমিক অসন্তোষ, অস্বাভাবিক ব্যাংক সুদহার এবং চরম বেকারত্ব। জিম্বাবুয়ের অর্থনীতির সব উপসর্গ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। জিম্বাবুয়ের ২০ শতাংশের ওপর ব্যাংক সুদহার। আর বাংলাদেশের সুদহার ১৬-১৮ শতাংশের মধ্যে। যেভাবে বাড়ছে তাতে এক যুগ আগের মতো ২২ থেকে ২৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকার আশঙ্কা রয়েছে। সুদের হার নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে নতুন ব্যবস্থা বা কৌশল দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। তবে কোনো কৌশল কাজে আসবে না কারণ অর্ধেকের বেশি ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে। একটি বড় অংশ সরকারের ইউটিলি বিল দিতে পারছে না। বেতন বন্ধ অনেক ব্যাংকের। অতিরিক্ত সুদের হার যে কোনো ধরনের ঋণগ্রহীতা এমনকি ব্যবসায়ীর জন্য অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে।

লেখক: সাংবাদিক

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সুশাসন নিশ্চিতে বিচারব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন : এমরান চৌধুরী

কুড়িগ্রামে যুবলীগ নেতা হাসেম আলী গ্রেপ্তার

চট্টগ্রামের কাঠালবাগান পাহাড়ে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ

রাবিতে পোষ্য কোটা বাতিল, ১২ ঘণ্টা পর মুক্ত প্রশাসন

‘সাত বিয়ে’র প্রসঙ্গে মুখ খুললেন সোহেল তাজ

চাঁদাবাজির অভিযোগে বিএনপি নেতা বহিষ্কার

যুবদল নেতা আক্তার বহিষ্কার

ছাত্র-জনতার অর্জিত বিপ্লব নস্যাতের ষড়যন্ত্র চলছে : জুয়েল

ব্যালন ডি’অর নিয়ে রোনালদোর মন্তব্যে রদ্রির ক্ষোভ

জকসু’র নীতিমালা অনুমোদন, শিগগিরই ঘোষণা হবে নির্বাচনী রোডম্যাপ : জবি উপাচার্য 

১০

খুলনায় ছাত্রদের দুপক্ষের সংঘর্ষের অভিযোগ, আহত ১৫

১১

শহীদ ওয়াসিমের নামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

১২

ভিন্ন ভূমিকায় ফিরলেন ছোটন

১৩

অযোগ্যদের কারণে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন বঞ্চিত ডেন্টাল টেকনোলোজিস্টরা : নুর

১৪

আমেরিকায় আর্চারির রোমান-দিয়া জুটি

১৫

এবার পায়ের রগ কেটে শ্রমিক দলের সভাপতিকে হত্যা

১৬

জবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটিকে লাল কার্ড দেখাল পদবঞ্চিতরা

১৭

ঢাবি সিন্ডিকেটে ডাকসু নিয়ে আলোচনা না করার দাবিতে ছাত্রদলের হট্টগোল

১৮

জাতি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সবক শুনতে রাজি নয় : গয়েশ্বর

১৯

‘ছাত্ররা এগিয়ে গেলে, দেশ এগিয়ে যাবে’

২০
X