শেষ হলো বহুল কাঙ্খিত মার্কিন নির্বাচন। এই নির্বাচনী যাত্রার শুরু থেকেই হাড্ডাহাড্ডি লড়ায়ের আভাস পেয়েছিলেন সবাই। কে জিতবেন- রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস, তা নিশ্চিত করে বলার সাহস দেখাতে পারেনি কেউ। তবে নির্বাচনের ফলাফলে শেষ হাসি হাসলেন ট্রাম্প। বিভিন্ন রাজ্য থেকে যখন নির্বাচনের ফলাফল আসতে শুরু করে তখন বরাবরই এগিয়ে ছিলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প। ফলে স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে হতাশা নেমে আসে কমলার শিবিরে। এমন প্রেক্ষাপটে কমলার প্রচারশিবিরের পক্ষ থেকে জানানো হলো, নির্বাচনের রাতে কমলা হ্যারিস সমর্থকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন না। সর্বশেষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় উদারপন্থীদের মনে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র সত্যিকার অর্থে একজন নারী প্রেসিডেন্ট পেতে প্রস্তুত আছে কিনা! পরে দেশটির বিভিন্ন নারী রাজনীতিবিদ ও সেলিব্রেটিদের নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে জনপ্রিয়তার ভোটে জয়ী হন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্যগুলোতে তিনি হেরে যান। জটিল ও যুক্তিযুক্তভাবে বলা যেতে পারে, অন্যায্য ইলেকটোরাল কলেজব্যবস্থায় তিনি প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে পারেননি। হিলারি হেরে গেছেন। কারণ তিনি দেশের শ্রমজীবী মানুষের মন জয় করতে পারেননি।
বিশ্বের তিন পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনে এখন পর্যন্ত কোনো নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাননি। এবারের নির্বাচনেরও ট্রাম্পের কাছে হেরে গেলেন কমলা হ্যারিস। ফলে যুক্তরাষ্ট্রবাসীর কাছে নারী সরকারপ্রধান এখনো অধরাই রয়ে গেছে। চীনে সু কিলিং উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। দেশটিতে অদ্যাবধি কোনো নারী সরকারপ্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেননি।
ইউরোপ কিংবা আমেরিকা নয়, আধুনিক বিশ্বে নারীর রাজনৈতিক জয়যাত্রা শুরু আমাদের এই মহাদেশে থেকেই। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের শুরুতে সিরিমাভো বন্দরনায়েকের দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র সিলনের (শ্রীলঙ্কার) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এরপর ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি আধুনিক বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান। বিশ্বের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হলেন আর্জেন্টিনার ইসাবেল ডি পেরন। তিনি দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তার স্বামী জোয়ান পেরন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হন। তবে বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রেসিডেন্ট হলেন আইসল্যান্ডের ভিগদিস ফিনবগিদত্তে। ১৯৮০ সালে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর আরো তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি মোট ১৬ বছর আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান হলেন বেনজির ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের প্রথম নারী সরকারপ্রধান। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধামন্ত্রী হন। বেনজির ভুট্টো বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান যিনি ক্ষমতাসীন অবস্থায় সন্তান জন্ম দেন। পরবর্তীকালে আরো একজন নারী ক্ষমতাসীন অবস্থায় সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তিনি হলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন।
বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্বপালনকারী সরকারপ্রধান হলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এরই পাঁচ মেয়াদে বিশ বছরেরও বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
আধুনিক বিশ্বে শতাধিক নারী নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই অনুপ্রেরণাদায়ী নারীরা বিভিন্ন পেশা থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে নাইট ক্লাবের নর্তকী, পুলিশ অফিসার, ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, সাংবাদিক, মনোবিজ্ঞানী, জৈব-রসায়নবিদ, হিসাবরক্ষক, গৃহিণী এমনকি গেরিলা যোদ্ধাও রয়েছেন। সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তারা দেশের বৈরী সময়ে এবং কঠিন পরিস্থিতিতে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করেছেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে শান্তিতে রূপান্তর, নারী এবং শিশুর জীবনমানের উন্নয়ন, বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে রাজনৈতিক দলে এবং জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থা আছে। এ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল, সার্বিয়া এবং রুয়ান্ডা অন্যতম।
যে শতাধিক নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ৪৪ জন ইউরোপের, ২৫ জন এশিয়ার, ১৫ জন আফ্রিকার, ১২ জন মধ্য আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান, ৪ জন প্রশান্ত মহাসগরীয় এবং মাত্র ২ জন উত্তর আমেরিকার (কানাডার কিম ক্যাম্বেল এবং গ্রিনল্যান্ডের আলেকা হ্যামন্ড উভয়ই এক বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছেন)। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এশিয়ার ৩০ শতাংশের বেশি নারী সরকারপ্রধান তাদের মতাদর্শের কারণে অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত মামলায় জেল খেটেছেন। দক্ষিণ আমেরিকার ৩০ শতাংশ নারী সরকারপ্রধান নানাভাবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক