কে এ এস মুর্শিদ
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বিশেষ সাক্ষাৎকার

মানুষ অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ন্যায্যতার সমাজ চাইছে

মানুষ অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ন্যায্যতার সমাজ চাইছে

কে এ এস মুর্শিদ বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণে টাস্কফোর্সের সভাপতি। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক মহাপরিচালক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। এর আগে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কম্বোডিয়ায় কর্মরত ছিলেন।

খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য, ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্টসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার গবেষণা রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, দেশের অর্থনীতি, আগামীর পরিকল্পনা, সমাজ-রাষ্ট্র-নাগরিক-রাজনৈতিক অর্থনীতিসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি।

কালবেলা: ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থান আপনি কীভাবে দেখেন?

কে এ এস মুর্শিদ: স্বাধীনতা যুদ্ধের পর নিঃসন্দেহে ছাত্র-জনতার এ গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধের আগেও এ ভূখণ্ডে রাস্তায় এত বড় আন্দোলন আর হয়নি। আমি ছাত্রাবস্থায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান দেখেছি, সেই আন্দোলনে আমি অংশগ্রহণও করেছি। আমার তারুণ্যে পাওয়া সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে এবারের ছাত্র আন্দোলন ’৬৯-এর মতো না হলেও তার প্রতিফলন আবারও দেখতে পেয়েছি। তবে গুণগত দিক থেকে অবশ্যই তফাত রয়েছে। আমরা এখন সংখ্যার দিক থেকে বড় একটি জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের ছাত্রসমাজ বহুগুণ বড় হয়েছে। এবারের ছাত্র আন্দোলনে অতীতের থেকে অনেক বেশি প্রাণহানি হয়েছে।

’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ বাংলাদেশের অন্যান্য আন্দোলনেও প্রাণহানি হয়েছে। সে সময়ও সহিংসতা হয়েছে। কিন্তু এবারের আন্দোলন তার সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। এ আন্দোলনে যত মানুষ হতাহত হয়েছে, সেটা স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ১৭-১৮ হাজার মানুষ কোনো না কোনোভাবে জখম হয়েছে। কেউ হাত হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, কেউ চোখ হারিয়েছে, কেউবা শরীরে জখমের ক্ষত নিয়ে আবারও রাস্তায় নেমেছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে এত ছাত্র-জনতার প্রাণহানি, যা এ আন্দোলনকে অন্য লেভেলে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।

কালবেলা: এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের কী বার্তা দেয়?

কে এ এস মুর্শিদ: এ গণঅভ্যুত্থান থেকে প্রাপ্ত বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রথমত, এ আন্দোলন বুঝিয়ে দিয়েছে যে, একটি সচেতন সমাজকে খুব বেশিদিন চেপে রাখা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করে কেউ টিকে থাকতে পারে না। আমরা চীন, রাশিয়া বা ভিয়েতনাম নই, তারা হয়তো অন্য অনেক দিক থেকে বেশি উন্নত কিন্তু বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে বাঙালিরা ছাড় দেওয়ার জাতি নয়। কারণ আমরা একটি টকেটিভ জাতি। আমাদের অভ্যাস সমালোচনা করা। যেই ক্ষমতা আসুক না কেন, মানুষ সরকারের সমালোচনা করতে অভ্যস্ত। হয়তো সিরিয়াসভাবে নয়, গল্পের ছলে হলেও মানুষ সমালোচনা করে থাকে। বলা যায় এটা আমাদের সংস্কৃতিরই একটি অঙ্গ। ফলে এ জাতির বাকস্বাধীনতা আটকে রাখলে তার বিস্ফোরণ ঘটবেই।

দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলন থেকে আমরা শিক্ষা পেয়েছি যে, মানুষের যখন কথা বলার স্পেস কমে যায়, মিডিয়াগুলো যখন আর স্বাধীনভাবে বার্তা প্রচার করতে পারে না, তখন মানুষ বিকল্প উপায় খুঁজে বের করে নেয়। এর ফলে অনেক সত্য ও মিথ্যা তথ্য ছড়ায়, অনেক জল্পনা-কল্পনার বিস্তার ঘটার সুযোগ তৈরি হয় এবং তাতে লাভ ও ক্ষতি উভয়ই হয়।

কালবেলা: বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। তারা সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিছু কাজও শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন দেখছেন?

কে এ এস মুর্শিদ: একটা সময় আমরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভালো করছিলাম। আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ভালো ছিল, রপ্তানিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের অর্থনীতিতে বহুমুখীকরণ ঘটছিল এবং আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে বাংলাদেশ সেই পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। আমাদের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে শুরু করে করোনার সময় থেকে। এ অবস্থায় তৈরি হয়েছে সরকারের দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে।

করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করে; সেটা আরও বেশি ত্বরান্বিত হয় নীতিনির্ধারকদের মিস ম্যানেজমেন্টের কারণে। একটা কারণ এমন হতে পারে যে, সরকার যখন দুর্বল হতে শুরু করে তখন ক্রোনি ক্যাপিটাল গোষ্ঠী হয়তো ভেবেছে যতটুকু পারা যায় লুটপাট করে নিতে। আর একটি সরকারের যখন মোরাল গ্রাউন্ড থাকে না, তখন নিজ দলের আশীর্বাদপুষ্ট এসব লুটপাটকারীকে ঠেকানোর কোনো শক্তিও তার থাকে না। প্রথমেই তারা ধ্বংস করে দিয়েছে অর্থনীতির মূল জ্বালানি শক্তি দেশের ব্যাংকগুলো। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মনে হচ্ছে, আমরা এখন ধীরে ধীরে সংকট সামলে উঠতে যাচ্ছি। আমাদের নতুন গভর্নর প্রথম দিন থেকেই দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন কোন জায়গায় কীভাবে কখন হাত দিতে হবে। ফলে আমরা এ সংকট কাটিয়ে উঠতে পারার সুযোগ দেখতে পাচ্ছি।

কালবেলা: অভিযোগ করা হয়, রাজনীতিতে যখন ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে তখন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন কিংবা লুটপাট অনেক বেশি বেড়ে যায়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

কে এ এস মুর্শিদ: এটা সত্যি, যখন ব্যবসায়ীরা রাজনীতির হাত ধরেন তখন রাষ্ট্র আর সাধারণ জনগণের থাকে না। ব্যবসায়ীদের দুই হাতে যখন দুটি হ্যাট থাকে, তখন কোনটা প্রাধান্য পাবে? অবশ্যই তাদের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের কারণে তারা অর্থ তৈরিকেই অগ্রাধিকার দেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে আসেন। তখন তাদের নিজের ব্যবসায়ী পরিচয়ের হ্যাটটি খুলে রেখে আসতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তেমনটা ঘটেনি। এখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেছেনই নিজেদের ব্যবসা বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে বড় করতে, অধিক অর্থ কামাতে। তারা দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার লক্ষ্য নিয়ে আসেননি বরং এসেছেন নিজেদের ব্যবসা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে। তারা মুখে বলেছেন একরকম কিন্তু কার্যত তারা শুধু নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।

কালবেলা: ’৯৬ সালের আওয়ামী লীগের শাসনামলের সঙ্গে গেল সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনামলকে কীভাবে দেখছেন?

কে এ এস মুর্শিদ: যারা সত্যিকারের রাজনীতিবিদ, তাদের পক্ষে এমনভাবে দুর্নীতি লুটপাট করা সম্ভব নয়। কারণ সত্যিকারের রাজনীতিবিদরা সবসময় এক ধরনের জবাবদিহি দেখে এসেছেন। রাজনীতিতে সত্যিকারের রাজনীতিবিদরাই থাকতেন তাহলে দেশটা এতটা নিচে নামতে পারত না। দেশে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেছেন, কিন্তু তারা গ্রাস রুট থেকে আসেননি। তারা ওপর থেকে প্যারালালভাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। ফলে তাদের সঙ্গে জনসাধারণের কোনো সংযোগ নেই। ফলে জনসাধারণের সঙ্গে দলের সম্পৃক্ততা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং একটি পর্যায়ে গিয়ে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে আমরা সেটাই দেখলাম। আমরা দেখেছি মাঠপর্যায়ে কী হচ্ছে, সেটা দলের ওপরের নেতৃত্ব দেখতেই পেলেন না। কারণ তাদের তোষামোদকারীরা তাদের সেই সংবাদ পৌঁছে দিতে পারেনি।

ব্যবসায়ীরা ছাড়া এখানে আরেকটি গ্রুপের বিরাট দায় রয়েছে। তারা হলেন দেশের আমলারা। আমলাদের বিরাট একটি গোষ্ঠী ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারা হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন এবং এর বেশিরভাগই অর্থ পাচার করেছেন। ফলে যখন ব্যবসায়ী এবং আমলাদের নেক্সাস তৈরি হলো, তখন সেটা আর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকেনি। জনসমর্থন প্রাধান্য না দিয়ে কোনো সরকার যখন আমলাদের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তখন এমনটা ঘটাই স্বাভাবিক।

কালবেলা: সরকার দেশের অর্থনীতির সংস্কারে হাত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের দ্রুত কাজ করা উচিত?

কে এ এস মুর্শিদ: সরকার অর্থনীতির জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে এবং আরেকটি শ্বেতপত্র তৈরি এবং প্রকাশের জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আমাদের সামনে মৌলিক কিছু কাজ রয়েছে আর বাকি কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো সম্পন্ন করা খুব একটা কঠিন নয়। ফলে তুলনামূলক সহজ কাজগুলো আগে সম্পন্ন করতে পারলে দ্রুত তার বেনিফিট পাওয়া যাবে। এরপর মৌলিক জায়গাগুলোয় ধীরে ধীরে হাত দিতে হবে। অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি সংস্কার প্রয়োজন নন-ইকোনমিক সেক্টরগুলোতে। কারণ আমাদের এখানে রুল অব ল দরকার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। যেমন কয়েক দিন আগে আশুলিয়াসহ অনেক জায়গায় কারখানা বন্ধ ছিল। এটা অর্থনৈতিক কারণে নয়। যদি আইন মেনে শ্রমিকদের যথাযথ অধিকার দেওয়া হয়, তাহলে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসবে।

অর্থনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জায়গায়ও দ্রুত সংস্কার করতে হবে। আমাদের বিচার ব্যবস্থা ও অ্যাকাউন্টিং সিস্টেম উন্নত করায় মনোযোগ দিতে হবে। দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগুলো ব্যবসার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে ঠিক করতে পারলে অর্থনীতিকে গতিশীল করা যাবে।

কালবেলা: প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিশাল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যায়। পাশাপাশি রয়েছে ঋণখেলাপির সমস্যা। অর্থ পাচার রোধ ও ঋণখেলাপি কমানোর জন্য কী করা যেতে পারে?

কে এ এস মুর্শিদ: বাংলাদেশের সিস্টেমটি এভাবে গড়ে তোলা হয়েছে যে, কেউ বেশি টাকা-পয়সার মালিক হলেই তা বিদেশে সরিয়ে নিতে চান। বিশেষ করে তারা উন্নত দেশগুলোতে সম্পদ নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। পশ্চিমাবিশ্ব যতই উচ্চ মোরাল গ্রাউন্ড থেকে কথা বলুক না কেন, তারাই অর্থ পাচারের মূল পৃষ্ঠপোষক। পাচারের এ বিপুল পরিমাণ অর্থ তাদের দেশেই যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ উন্নত দেশগুলোতে পাচার হচ্ছে। সরকারের চেষ্টায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রোধ করা যতটুকু সম্ভব তার থেকে বেশি সম্ভব হতো যদি উন্নত দেশগুলো সে দেশে টাকা ঢুকতে বাধা দিত।

কালবেলা: বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে এ ঋণ আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?

কে এ এস মুর্শিদ: আমাদের রিজার্ভ লুটপাট হয়ে গেছে, হুন্ডিসহ নানাভাবে লক্ষ-কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সাদা হস্তীর মতো বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিপুল পরিমাণ টাকা অপচয় হয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে বিদেশি ঋণ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আমরা নানাভাবে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়েছি। এর মধ্যেই বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। ফলে অর্থনীতির ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বাঁচার জন্য আমাদের অতিসত্বর পদক্ষেপ নিতে হবে। অপচয় রোধ করতে হবে, আমাদের রেমিট্যান্সে যেন আরও গতি পায় সেই প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।

আমরা যদি এখনই পদক্ষেপগুলো না নিতে পারি তাহলে সামনে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়ব। এই মুহূর্তে অর্থনীতির বহুমুখীকরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই। তবে আমাদের জন্য আশার কথা হলো, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি পশ্চিমাবিশ্বসহ জাপানের শুভকামনা রয়েছে। ফলে সেসব জায়গা থেকে আমরা কিছু সুবিধা পেতে পারি। তারা আমাদের জন্য সফট ফাইন্যান্সিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। যদি আমরা সেসব দেশে বাজার সুবিধা পাই, সেটা হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় উপকারী।

আমরা জানি পশ্চিমাবিশ্বের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব দিনে দিনে বাড়ছে। চায়নিজ পণ্যের ওপর ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো অনেক ধরনের ট্যারিফ বসাচ্ছে। এটা সামনে আরও বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি সেসব দেশের মার্কেটে প্রবেশ করতে পারি, তবে বাংলাদেশ লাভবান হবে। অনেক শিল্প বাংলাদেশে চলে আসবে। অর্থাৎ তারা আমাদের এখানে বিনিয়োগ করে কারখানা গড়ে তুলবে। এটা আমাদের সামনে একটি বড় সম্ভাবনা। অন্যান্য বিদেশি সাহায্য বা ঋণের থেকে যদি এ দিকটাতে আমরা কৌশলগতভাবে গুরুত্ব দিই এবং আমাদের ডিপ্লোম্যাসিকে কাজে লাগাই, তাহলে এ সুযোগটা আমরা গ্রহণ করতে পারব। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ফলে তিনি যদি শক্তভাবে মাঠে নামেন, তাহলে আমরা খুব দ্রুত এ অবস্থা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে অগ্রসর হতে পারব।

কালবেলা: আমাদের মোট বার্ষিক আমদানির একটি বড় অংশের জন্য আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কীভাবে এগোনো উচিত বলে মনে করেন?

কে এ এস মুর্শিদ: আমরা জানি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে আমাদের নতুন দরকষাকষি হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত ট্রেনগুলো জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সময় থেকে বন্ধ রয়েছে। দুই দেশের ট্রানজিট সুবিধাগুলোও বন্ধ রয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কানেকটিভিটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। এই কানেকটিভিটি কতটুকু হবে, তা অর্থনৈতিক চাহিদা ও জোগান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সুতরাং এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের যে কানেকটিভিটি রয়েছে, তা যথেষ্ট কি না। যদি যথেষ্ট না হয় তাহলে আমরা তা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে পারি।

ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যের আকার ও ধরন কতটুকু এবং কেমন হবে, তা হিসাব-নিকাশ করেই আমাদের এগোতে হবে। তবে আমি মনে করি কোনো একটি দেশের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হওয়া ভালো নয়। বিশেষ করে সেটি যদি হয় পার্শ্ববর্তী দেশ। কারণ, যদি কখনো কোনো একটি বিষয়ে অমিল ঘটে তখন তারা সেই নির্ভরশীলতা পুঁজি করতে পারে। সুতরাং খাদ্য ও জ্বালানি-বিদ্যুতের মতো মৌলিক জায়গাগুলোতে আমাদের বহুমুখীকরণ দরকার। যতটুকু সম্ভব এই ক্ষেত্রগুলোতে নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।

কালবেলা: আগামীর বাংলাদেশের কীভাবে এগোনো উচিত বলে মনে করেন?

কে এ এস মুর্শিদ: আমরা এতদিন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে কৌশল অবলম্বন করেছি, তার পরিবর্তন দরকার। অনেক বিষয়ে হয়তো আমরা সঠিকভাবেই এগিয়েছিলাম এবং ঠিক পথে এগিয়েছিলাম। কিন্তু এমন অনেক ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে। এটা এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমরা ঠিকমতো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি এবং দেশে সম্পদের বৈষম্য অনেক বেড়েছে। ফলে আগামীর বাংলাদেশের জন্য আমাদের কৌশল বদলাতে হবে।

দেশ গঠন করতে এবং দেশকে নতুন করে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের সার্বিক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন। ভবিষ্যতের পথে এগোতে হলে আমাদের টেকনোলজি চাহিদা এবং স্কিল চাহিদাকে মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি কোন কোন সেক্টরগুলো আমরা বিশেষভাবে গুরুত্ব দেব, তা নির্দিষ্ট করতে হবে। শিল্প খাতের পাশাপাশি আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। একটি টেকসই অর্থনীতি এবং সমৃদ্ধ দেশ নির্মাণে সবাইকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে।

কালবেলা: অনেকে সমাজ সংস্কারের কথা বলছেন। এটা কীভাবে হতে পারে বলে মনে করেন?

কে এ এস মুর্শিদ: আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে সমাজ সংস্কারের জোরালো দাবি দেখা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। তরুণ ছেলেমেয়েরা সমাজ সংস্কারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। তারা ইনক্লুসিভ সমাজের কথা বলছে। জাতি-ভাষা-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে তারা মূল্যবোধভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা বলছে। তাদের এ অনুভব এবং চাওয়া আমাদের সবাইকে ধারণ করতে হবে। তাদের এ চাওয়াকে আমরা যদি নির্মাণ করতে পারি, সেটা হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন।

কালবেলা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?

কে এ এস মুর্শিদ: অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রথম চাওয়া, তারা যেন এ দেশের রাজনীতির একটি ন্যূনতম সংস্কার এনে দিতে পারে। আমরা যেন রাজনৈতিক পাওয়ার ট্রানজিশনে একটি নিরাপদ ও স্মুথ প্রক্রিয়া দেখতে পাই। এটা নিয়ে যেন আর কোনোদিন আমাদের দুশ্চিন্তা না থাকে। তারা যেন আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় একটি নতুন সূচনা এনে দিতে পারে। হাজার হাজার মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটি স্বৈরতান্ত্রিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে নতুন পথে যাত্রা শুরু করেছি। এ সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মানুষ এখন রাষ্ট্র সংস্কার চাইছে। মানুষ চাইছে সব রাষ্ট্রীয় অন্যায়, অনিয়ম, অবিচারের অবসান ঘটিয়ে একটি ন্যায্যতার ভিত্তিতে গঠিত সমাজ। যেখানে মানুষ নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকারগুলো চর্চা করতে পারবে। আমি আশাবাদী, এ সরকার বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় নতুন যাত্রার সূচনা ঘটাতে পারবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নিলামের আগে আইপিএলের দলগুলোকে যে বার্তা দিল বিসিবি

বগুড়ায় অস্ত্রসহ কৃষক লীগ নেতা গ্রেপ্তার

রংপুরে বীজ আলুর সংকট, দিশাহারা কৃষক

সব যোগ্যতা থাকার পরও জিয়ার নাম থাকায় মেলেনি এমপিও

অতিরিক্ত ওজন কমাবে শীতের যেসব সবজি

জুরাইন রণক্ষেত্র, অবরোধকারীদের কয়েকজন আটক

রাশিয়া শান্তি চায় না, এবার জবাব দিতে হবে : বিশ্বকে জেলেনস্কি

মাছ ধরার নৌকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিনের ধাক্কা

বেঁচে ফিরব আশা ক‌রিনি

পানের বরজে গাঁজা গাছ

১০

ব্যাংককে রাফসান-জেফার, উড়ো প্রেমের গুঞ্জন (ভিডিও)

১১

জনবল নিয়োগ নিচ্ছে নিটল মটরস, কর্মস্থল ঢাকায়

১২

পাত্র খুঁজছেন পাকিস্তানি অভিনেত্রী মেহউইশ হায়াত (ভিডিও)

১৩

ঢাকায় পৌঁছেছেন বাইডেনের বিশেষ প্রতিনিধি

১৪

৪২ টাকায় কেনা কলার চিত্রকর্ম ৭২ কোটিতে বিক্রি

১৫

এবার অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নারী বেছে নিলেন ট্রাম্প

১৬

ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হওয়ায় গন্তব্যে পৌঁছাতে আড়াই ঘণ্টা পার

১৭

বিচ্ছেদের পর এই প্রথম এআর রাহমানের পোস্ট

১৮

লঘুচাপের শঙ্কা, এরপরই জেঁকে বসবে শীত

১৯

রংপুর জিলা স্কুল মাঠ নয়, মাহিগঞ্জ কলেজে হচ্ছে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ

২০
X