প্রেমের পরিণতি বিয়ে। সংসারে অশান্তির পরিণাম তালাক। আলোচনা ভেঙে গেলে যুদ্ধ। আবার আলোচনা ফলপ্রসূ হলে যুদ্ধের সমাপ্তি। এরকম সবকিছুরই শেষ আছে। শুধু নেই রাজনীতিতে। আধুনিক রাজনীতির এ এক শুভঙ্করের ফাঁকি। ‘রাজনীতিতে শেষ বলতে কিছুই নেই’—যুক্তরাজ্য়ের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন ডিসরাইলির এ আপ্তবাক্য়ের সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর রাজনীতির অবনমন ঘটিয়ে চলেছে সুযোগসন্ধানীরা। ব্য়ক্তিগত উন্নতির আশায় সবলের চামচামি আর দুর্বলের প্রতি আগ্রাসী আচরণ করে তারা। দ্রুত প্রভাবশালী হতে গিয়ে রাজনৈতিক ঐতিহ্য়কে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। ক্ষমতা ও প্রভাব বজায় রাখতে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দেয় তথাকথিত রাজনীতিবিদরা। কেতাবি আদর্শের কথা বলে দলকে গোয়ালে পরিণত করতেও দ্বিধা করেন না। দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে জোটের লাভ দেখে হাইব্রিড নেতারা।
তিলকে তাল, তালকে তিল করার নোংরা খেলায় অশ্লীল বিনোদন ছাড়া সাধারণ জনগণের তেমন কোনো লাভ হয় না। তবু দিনের পর দিন শত শত কর্মঘণ্টা নষ্ট করছে অতিউৎসাহী জনতা। ভারতীয় চিন্তাবিদ ওশো মনে করেন, ‘রাজনীতি একটা খেলা, চালাক লোকেরা খেলে আর মূর্খরা দিনভর সেটা চর্চা করে।’ অথচ রাজনীতি বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজনীতির বাইরে কিছু না। রাষ্ট্র-দেশপ্রেম-মানবাধিকার-যুদ্ধ-বাণিজ্য়-জন্ম-মৃত্য়ু-বিয়ে-শিক্ষা-স্বাস্থ্য়-বিনোদন সবকিছুই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতি দ্বারা সব পরিচালিত হয়। আর দলীয় আদর্শ ও এজেন্ডা মেনে এসব নিয়মনীতি তৈরি করেন রাজনীতিবিদরা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত নেতারাই হন আইনপ্রণেতা। সরকার গঠনে আইনপ্রণেতা কেনাবেচা এবং পরস্পরবিরোধী আদর্শের দল জোটে টানা উপমহাদেশের রাজনীতিতে অতিপরিচিত সাধারণ ঘটনা।
শুধু গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক নয়, রাজতন্ত্র বা ছুমন্তরের দেশেও রাজনীতি খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিজ্ঞানের আকাশ-বাতাস-মাটি-পানি নানা শাখায় বিশ্বসেরা মেধাবীদের প্রতিযোগিতা দেখা গেলেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাদের আগ্রহ কম। অথচ রাষ্ট্র পরিচালনাকারী রাজনীতিবিদ হন অন্য়ান্য় শাখার মেধাবীদের ভাগ্য় নিয়ন্ত্রক। এটা শুধু বাংলাদেশ, এশিয়া বা গরিব রাষ্ট্র নয়, উন্নতদের বেলায়ও করুণ বাস্তবতা। কৃত্রিম মানুষ (রোবট) বানিয়ে তাকে দিয়ে দ্রুততম সময়ে জটিল ও কঠিন কাজ করাতে পারছে মেধাবী বিজ্ঞানীরা। কিন্তু রক্ত-মাংসের তৈরি মাটির মানুষ পরিচালনার ঝুঁকি নিতে চায় না মেধাবীরা। ফলে রাজনীতিতে সহজেই অনুপ্রবেশ করে অসৎ, ধান্দাবাজ, অমানুষ প্রকৃতির লোক। নিজেদের স্বার্থে সাধারণ মানুষের জানমাল নিয়ে খেলে তারা। সম্মোহনী প্রতিভার মাধ্য়মে নিরীহ জনতার আবেগ দুষ্টু ডাইনির মতো ব্য়বহার করে। দুনিয়াজুড়ে এই হয়ে আসছে যুগে যুগে। এরই মধ্যে রাজনীতিতে কিছু উদ্য়মী, ভালো মানুষ থাকায় সভ্য়তা এসেছে, পৃথিবী এগিয়েছে। যদিও নেতৃত্বের দোষ-গুণ বিচারে পৃথিবীর আগানো-পেছানো নিয়ে নানা বিতর্ক চলমান দুনিয়াজুড়ে। আর বাংলাদেশ তো দিনের মধ্য়ে কয়েকবার আগু-পিছু করে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদদের বাক্য়বাণে প্রতিনিয়ত কম্পমান ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। এসব ক্য়াচালে দেশটির টিকে থাকাটাই রীতিমতো বিস্ময়ের। হুমকি-ধমকির রাজনীতি পুরোপুরি সত্য়ি হলে খেটে খাওয়া মানুষ আর খাটে ঘুমাতে পারত না। প্রতি মুহূর্তে খাটিয়ার দুঃস্বপ্ন নিয়ে অসাড় হয়ে থাকত। কিন্তু কী করা যাবে! দেশ চালাতে শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদকেই বেছে নিতে হয়।
এর আগেও একাধিকবার মেধাবী, বিশেষজ্ঞ ব্য়ক্তিত্ব দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাতে শেষরক্ষা হয়নি। ফিরে যেতে হয়েছে রাজনীতিবিদের কাছে। কেননা, সব মানুষ সুশীল হয় না। আস্তিক-নাস্তিক-চোর-বাটপার-পরিশ্রমী-সৎ-ভণ্ড-মেধাবী-উদ্য়োক্তা-লুটেরা সব নিয়েই জনগণ। তাদের পরিচালনার জন্য় রাষ্ট্রবিজ্ঞান জরুরি। আর এর প্রয়োগে বিজ্ঞানী হলো রাজনীতিবিদ। যদিও তারুণ্যের জনপ্রিয় কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তার ‘হাড়েও ঘরখানি’ কবিতায় লিখেছেন, “বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে/ রাজনীতিকের ধমনী শিরায় সুবিধাবাদের পাপ”। রুদ্র নিজেও ছাত্রনেতা ছিলেন। রাজনৈতিক মারপ্য়াঁচে পড়ে তার এই কাব্য়িক অনুভূতি হতে পারে। রাজনীতিতে কোনো নাগরিককেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বেশ্য়া-ব্য়বসায়ী-আমলা-পুরোহিত-কবি-বেকার-শিক্ষার্থী সবার মন জয় করতে হয় রাজনীতিবিদকে। অত্য়াবশ্য়কীয় এ মাধ্য়মে সম্মানের পাশাপাশি সম্পদ অর্জনের অপার সম্ভাবনা থাকায় অনিবার্যভাবে সুবিধাবাদী লোক ঢুকে পড়ে। তবে একজন সফল ব্য়বসায়ী বা আমলার চেয়ে একজন রাজনীতিবিদকে অনেক বেশি ধকল সহ্য় করত হয়। তা ছাড়া জনসম্পৃক্ত না থাকলে রাজনীতিবিদের সফলতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
পেশাদার রাজনীতিবিদদের মধ্য়ে একসময় আইনজীবী ও শিক্ষকরা ছিলেন অগ্রগণ্য়। জনসম্পৃক্ততা ও পেশার কারণে দেশপ্রেম এবং সততা চর্চার অভ্য়াস ছিল তাদের। ক্ষমতার রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দিনে দিনে ব্য়বসায়ী ও আমলাদের বাম্পার ফলন হয়েছে রাজনীতিতে। গত দেড় দশকে শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে দলীয় মনোনয়ন উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন ব্য়বসায়ী ও আমলাদের জন্য়। এতে শুধু তার দলের ত্য়াগী নেতা নয়, বঞ্চিত হয়েছে দেশের রাজনীতি। সংখ্য়াগরিষ্ঠ আইনপ্রণেতা ব্য়বসায়ী ও আমলা হওয়ায় সংগত কারণেই রাষ্ট্র এবং জনগণের সঙ্গে ক্ষমতা ও মুনাফার রাজনীতি করেছে তারা। এর অভিঘাতে তিল তিল করে গড়ে ওঠা পেশাদার আমলাতন্ত্র ভেঙে পড়ে। দলীয় আনুগত্য় দেখিয়ে চাকরিরত অবস্থায় দ্রুত পদোন্নতি পান আর অবসরের পর হন এমপি। অতীতেও অবসরের পর আমলারা রাজনীতিতে নেমেছেন। কিন্তু চাকরিরত অবস্থায় এতটা দলীয় নির্লজ্জতা দেখাননি। পলাতক ফ্য়াসিস্ট সরকার গণতন্ত্রের পাশাপাশি আমলাতন্ত্রও ধ্বংস করে গেছে। রেখে যাওয়া রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্য়বসায়ী সিন্ডিকেট এখনো ভাঙতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্জ্বালায় ক্ষতবিক্ষত একশ্রেণি তাই বলে—এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম! যদিও স্বেচ্ছাচারীর মতো বাকস্বাধীনতা উপভোগ করছে তারা।
রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি হাইজ্য়াক হয়ে গেছে অনেক আগেই। শুধু আমলা-ব্য়বসায়ী নয়, রাজনীতিকে সবচেয়ে বেশি কলুষিত করেছে দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নানা ইস্যুতে দিনের পর দিন মানুষের মনোযোগ নিয়ে খেলেছে তারা। একই সঙ্গে রাজনীতিকে অজনপ্রিয় করে তুলতে নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন। ত্য়াগী নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে সন্ত্রাসী, কালোবাজারি, দুর্নীতিগ্রস্ত লোককে দলীয় মনোনয়নের জন্য় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্য়দিকে, রাজনীতির বিরুদ্ধে কৌশলে বিষোদ্গার করা হয়। যাতে সচেতন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন এরকমই একটা ষড়যন্ত্র। হোটেল-রেস্টুরেন্টে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক অপপ্রচার। সংস্কৃতিচর্চা তথা প্রতিবাদের ভাষা নির্মূলে সামনে আনা হয়েছে জঙ্গি নাটক। কিন্তু মনস্তত্ত্ব বড়ই অদ্ভুত! সারা দিন রং-তামাশা করে ঘুরে বেড়ালেও বাড়ি ফেরার আগে ঘরের মানুষের কথা মনে পড়বেই। মূলে ফিরতেই হয় মানুষকে। তখনই জেগে ওঠে তার আত্মজিজ্ঞাসা।
গণতন্ত্র নস্য়াৎ করে দেশের রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলায় এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘদিন জোর-জবরদস্তি চর্চার এ এক অনিবার্য পরিণতি। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ দেয়নি আওয়ামী লীগ। পরিণামে ঘরে ঘরে রাজনীতিবিদ তৈরি হয়েছে। এখন নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারকেও রাজনীতি করতে হচ্ছে। ছাত্রদের মনোনীত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি পরামর্শের নামে হুমকিও দিচ্ছে বৈষম্য়বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি তোলে তারা। বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি দেখে গণভবনের পরিণতি আশঙ্কা করে অনেকে। এরকম পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্য়মে বঙ্গভবন রক্ষা করে ইউনূস সরকার। উইন উইন সিচুয়েশনে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তারা। কিন্তু এভাবে কত দিন? সরকারের অন্য়তম শুভাকাঙ্ক্ষী দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চায় না রাষ্ট্রপতির অপসারণ। তারা মনে করে, এতে সাংবিধানিক সংকটে পড়বে দেশ। যদিও সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলছে না। তবু বিএনপিকে গুরুত্ব দিয়েই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আসলে রাজনীতি একটি সার্বক্ষণিক চর্চা। বিখ্য়াত সমরবিদ ও রাজনীতিবিদ উইনস্টন চার্চিল বলেছেন, ‘রাজনীতি প্রায় যুদ্ধের মতোই উত্তেজনাপূর্ণ এবং বেশ বিপজ্জনক। যুদ্ধে আপনি কেবল একবার হত্যা করতে পারেন। তবে রাজনীতিতে অনেকবার।’
কিন্তু রাজনীতি ছাড়া দেশ অচল। কল্য়াণমুখী রাষ্ট্র গড়তে আধুনিক ও মানবিক রাজনীতির বিকল্প নেই। তবে নীতিনৈতিকতা, মূল্য়বোধের একটা মাপকাঠি থাকা দরকার। কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পথহারা রাজনীতিকে সুসংগঠিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ধামাধরা, অযোগ্য় নেতৃত্বের সংস্কার জরুরি। রাজনীতি শুধু রাজনীতিবিদই করতে পারবে—তা নয়। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ স্বভাবতই একটি রাজনৈতিক প্রাণী।’ তাই দক্ষ, আন্তরিক, আগ্রহী কাউকে বাধা দেওয়া যাবে না। নানা পেশার মানুষই রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে নিজ নিজ পেশার অভিজ্ঞতা নিয়ে জনকল্য়াণের রাজনীতিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী, স্বৈরাচার বা তাদের দোসর, সন্ত্রাসী বা দুর্নীতিবাজদের রাজনীতির বাইরে থাকাই ভালো। যোগ্য়দের হাতে থাকলে রাজনীতি তার হারানো সম্মান ফিরে পাবে। সে ক্ষেত্রে একজন ব্য়বসায়ীও ভালো রাজনীতিবিদ হতে পারেন। মার্কিন ব্য়বসায়ী হেনরি ফোর্ড মনে করেন, ‘রাজনীতিকে সৎ রাখতে পারে একটি মাত্র উদ্দেশ্য, তা হলো দেশ এবং তার জনগণের জন্য ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য়।’
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, কালবেলা