সবজি বাজারে সবার একটা প্রশ্ন—কী কিনব? সবজির যা দাম? তাতে কিছুতে হাত দিতেই ভয়। এরপর এক কেজির জায়গায় আধা কেজি, আধা কেজির জায়গায় ২৫০ গ্রাম কিনে বাসায় ফিরছেন। এমন নয় যে, বাজারে সবজি পাওয়া যাচ্ছে না, কোনোটারই তেমন ক্রাইসিস নেই। তবে এ বছর খরা, টানা বৃষ্টি এবং স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কারণে শাকসবজির চাষ মারাত্মক বিঘ্নিত হয়েছে। ফলে দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের আমদানি শুল্ক কমানো, ওএমএসের মাধ্যমে কৃষিপণ্য বিক্রি, বাজার তদারকিসহ বিভিন্ন উদ্যোগ সত্ত্বেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হয়ে উঠছে না সাধারণ ক্রেতাদের। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ জীবন চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, দ্রব্যমূল্য কেন এত বাড়ছে? দাম কমাতে এখন পর্যন্ত সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা কি যথেষ্ট? জিনিসপত্রের দাম কমাতে কী কী করণীয় আছে?
দাম বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হতো পথে পথে ও বাজারে সরকারদলীয় লোক ও পুলিশের চাঁদাবাজি। বর্তমানে দাবি করা হচ্ছে, বর্তমানে রাস্তায় নামে-বেনামে কমেছে চাঁদাবাজি। তারপরও পণ্যের দাম কমেনি। বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উৎপাদনকারী থেকে পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। ট্রাক থেকে প্রথমে পণ্য যায় আড়তে, সেখানে থেকে পণ্য কেনেন পাইকার বা ফড়িয়ারা। পরে ফড়িয়াদের কাছ থেকে বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করেন। খুচরা বাজারে পণ্য পৌঁছাতে পরিবহন খরচও আছে। কারওয়ান বাজার থেকে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে প্রতি ভ্যান সবজির ভাড়া কমপক্ষে ৪০০ টাকা। এরপর কিছু মালপত্র নষ্ট থাকে। সেগুলো কম দামে বিক্রি করতে হয়। শুকিয়ে ওজনে ঘাটতি হয়। এরপর দোকান ভাড়া, লেবার বিল, কর্মীদের বেতন রয়েছে।
সবজি দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ সম্পর্কে কথা হয় রংপুরে আল-আমীনের সঙ্গে। কীভাবে দর বাড়ে, তার কিছুটা ধারণা দেন তিনি। তার ভাষ্য, ক্ষেত থেকে সবজি নিয়ে স্থানীয় আড়তে যায় কৃষক। সেখান থেকে কেনে ব্যাপারীরা। এখানে সবজির মোট কেনা দরের সঙ্গে ৫ শতাংশ আড়তদারি দিতে হয়। অর্থাৎ ২০ টাকার পণ্যে ২২ টাকা দিতে হয়। সবজি ট্রাকে তোলা বাবদ শ্রমিক খরচ প্রতি ট্রাকে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মতো। রংপুর থেকে ঢাকায় আনতে ভাড়া লাগে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। প্রতি ট্রাকে ১০ থেকে ১২ টন আনা যায়। ঢাকায় আনার পর প্রতি ২০ টাকার সবজি বিক্রির বিপরীতে আড়তদারি দিতে হয় কমিশন। এসব খরচ ও লাভ যোগ করে দেখা যায়, ২০ টাকার সবজির বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৩৫ টাকা।
এবার আসা যাক, আড়ত থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা কীভাবে দর বাড়ায়। তিন যুগের বেশি সময় ধরে কারওয়ান বাজারে খুচরা বাজারে সবজি বিক্রি করেন আবদুর রশিদ। তার ভাষ্য, কারওয়ান বাজারে রাতে সবজি আসার পর ব্যাপারীরা কয়টি ট্রাক এসেছে, কী পরিমাণ এসেছে এসব খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে। পরিমাণে কম এলেই পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের ভিড় বাড়তে থাকে। তখনই দাম বাড়াতে শুরু করে। এমনও দেখা যায়, শুরুতে যে লাউ প্রতিটি ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে; শেষদিকে তা ৬০ থেকে ৭০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাস্তবে ঢাকা ও তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে, পণ্য উৎপাদনের পর বিক্রি করে ঠকছেন কৃষক এবং ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে চড়া দামে কিনতে গিয়ে ঠকছেন ভোক্তা আর বাকি সবাই লাভবান হচ্ছেন।
ভোক্তারা কীভাবে ঠকছেন তার চিত্র কিন্তু সম্প্রতি আমরা কুমিল্লা জেলা নিমসার বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স অভিযান পরিচালনায় দেখেছি। স্থানীয় প্রান্তিক চাষিরা ঝুড়িতে করে কাঁচা শাকসবজি আনলেও ঝুড়ি পড়তেই অন্তত ৩০০ টাকা দেওয়া লাগত চাঁদাবাজদের। এ ছাড়া যে কোনো ব্যবসায়ী অল্প পরিমাণে শাকসবজি বিক্রি করলেও প্রতি মুঠা বা কেজিপ্রতি চাঁদাবাজদের টাকা দিতে হতো। যে কারণেই পাইকারি বাজার থেকে শাকসবজি কিনে নিয়ে বাজারে অন্তত ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি ধরে বিক্রি করতে হয় সাধারণ মানুষের কাছে। অন্যদিকে একই পণ্য পরিবহনের জন্য পরিবহন টোলও আদায় করা হয়। এভাবে বেপরোয়াভাবে খাজনা ও চাঁদা আদায়ের কারণে খুচরা পর্যায়ে শাকসবজির দাম হতো বেশি।
অসাধু সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় শাকসবজি বিক্রি শুরু করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। রাজধানী ঢাকায় কম মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির উদ্দেশ্যে ‘স্বস্তির হাট’ চালু করেছে বাংলাদেশ পেশাজীবী অধিকার পরিষদ। ট্রাকে করে সবজি ও খাদ্যসামগ্রী বিক্রি শুরু করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। বাজারের নিয়মিত মূল্যের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী সুলভমূল্যে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ১৫টি উৎপাদক অঞ্চল থেকে কৃষিপণ্য সংগ্রহ করে দেশব্যাপী সরবরাহ নিশ্চিতের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল কর্তৃপক্ষ। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সরকার করপোরেটদের হাতে বন্দি নয় জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে যে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছে সরকার।
নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে সম্প্রতি সরকার বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এ টাস্কফোর্সসহ ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে বাজার তদারকি করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে পরিবহনে চাঁদাবাজি কমলেও আড়তদার ও মিলমালিকদের কারসাজি কমেনি। এ বিষয়েও আশা করি সরকার দৃষ্টি দেবে। মুক্তবাজার মানে যা খুশি করা নয়। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও তদারকির মাধ্যমে সব শ্রেণির ব্যবসায়ীকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় এনে বাজারে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করি। সরকার মনিটরিং বজায় রাখলে বাজার নাগালে রাখা সম্ভব।
কৃষি বিপণন বিভাগ থেকে এরই মধ্যে ডিম, আলু ও পেঁয়াজসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এটা কার্যকরে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। স্টোরেজ সিস্টেম ডেভেলপ করে সবজির সংরক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিপণ্য উৎপাদনের সুদিন এলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে হবে। প্রতি ইউনিট উৎপাদন দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করতে হবে। প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে হবে পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে। উৎপাদন কম হলে দ্রুত আমদানির ব্যবস্থা নিতে হবে। মোট কথা, পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।
লেখক: উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়