মধ্যপ্রাচ্য উত্তেজনা বা যুদ্ধাবস্থা কোন দিকে ধাবিত করছে আরববিশ্বকে—প্রশ্নটি এখানেই থেমে নেই। কেননা এ অঞ্চলের উত্তেজনা আরববিশ্ব ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কাও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আগে থেকেই গুঞ্জন রয়েছে বিশ্বমহলে। অবশ্য ইরানের ওপর এ সপ্তাহে ইসরায়েলের সর্বশেষ ভয়ানক আক্রমণের পর ইরানের পাল্টা আক্রমণের সম্ভাবনা এবং তা কোন ভয়াবহতার দিকে পরিস্থিতি ধাবিত করতে পারত—তা নিয়ে বিরাট শঙ্কা থাকলেও আপাতত ইরানের প্রতিক্রিয়ায় সেই শঙ্কা করছেন না বিশ্লেষকরা। এটি এই মুহূর্তের জন্য স্বস্তির খবর হলেও দীর্ঘমেয়াদে অঞ্চলটিতে স্বস্তি ও শান্তির কোনো ইঙ্গিত পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেননা শুধু ইরান নয়, একই সঙ্গে এ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন, লেবাননও। এটা উদ্বেগের।
গত শুক্রবার রাজধানী তেহরানসহ বিভিন্ন এলাকায় রাতভর ইসরায়েলি হামলা পরিচালিত হয়। এতে নিহত হয় ইরানি চার সৈন্য। এর প্রতিক্রিয়া ইরান জানাবে কি না, তা এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, হামলাটি দেশ দুটির মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে ভয়ানক মাত্রা যুক্ত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলা ও পাল্টা হামলা যদি চলতে থাকে তাহলে একপর্যায়ে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যাবে। তবে ইরানে এ হামলাকে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার এবং এতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ইরানকে পাল্টা হামলা না করতে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সার্বিকভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে যদি হতো যুক্তরাষ্ট্রের এ সতর্কতা—তা নিশ্চয়ই ইতিবাচক হিসেবে ভাবা যেত। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশে বিশেষ করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল এই মুহূর্তে যে বর্বরতায় মত্ত, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বব্যাপী সমালোচিত ও প্রশ্নবিদ্ধ। গত এক বছরের কথাই যদি ধরা যায়, দেখা যাবে ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনিদেরই হত্যা করেছে ৪২ হাজারের বেশি। সমগ্র ভূখণ্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধ, প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তাকে। এ ইস্যুতে বারবার দেখা গেছে আমেরিকার ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন। এমনকি তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র ও সেনা দিয়ে সহযোগিতা করছে প্রকাশ্যেই। সাম্প্রতিক সময়ে লেবাননের ইরানের সহযোগী হিজবুল্লাহর ওপর হামলার নামে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সাত শতাধিক লেবানিজকে হত্যা করেছে। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াসহ ইরান ও তার মিত্র শক্তিগুলোর শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আবার ইরানের আরেক সহযোগী ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলমান।
ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ওপর যা করছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি আইনের লঙ্ঘন। অথচ বিশ্বব্যবস্থা মানবতার বিরুদ্ধের এ অপরাধকে থামাতে পারছে না। প্রতিদিন নিরীহ ফিলস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের এ হত্যাযজ্ঞ—আধুনিক সভ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সভ্যতার নামধারণ করে তা অসভ্যতাই জারি রেখেছে! আমরা মনে করি, যুদ্ধ কোনোদিন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। হিংসা দিয়ে হিংসা রোধ করা যায় না। তাই ইরান-ইসরায়েল তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সহিংসতা, যুদ্ধ বন্ধ হোক। এজন্য বিশ্বনেতৃত্ব ও সংস্থাগুলোর পাশাপাশি আরববিশ্বের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান অত্যন্ত জরুরি। আমাদের প্রত্যাশা, সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ পরিহার করতে সবাই আন্তরিক হবে।