ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর কেটে গেছে আড়াই মাস। এই রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা কর্তৃক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে দেড় সহস্রাধিক মানুষ। রাজপথে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ। এখনো থামেনি সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। দুর্বিষহ যন্ত্রণায় এখনো আহতরা দিশেহারা। তাদের কষ্টে ভারী হয়ে আছে বাতাস।
শেখ হাসিনার কোনো নীতি ছিল না, দুর্নীতি ভিন্ন। সৌভাগ্য আমাদের, শেখ হাসিনার এই নৈতিকতাকে দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। তার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। এই বিক্ষুব্ধ হওয়ার অনেক কারণ ছিল। সর্বজনীন ও সর্বাধিক শক্তিশালী কারণ হলো—মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতারণা, প্রহসন এবং ভণ্ডামি। এসব কারণে সর্বস্তরের মানুষ তাকে হৃদয়ের গভীর থেকে ঘৃণা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে রেখে তিনি এবং তার দলের লোকেরা দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এসব টাকা বিদেশে পাচার ও বিশ্বের উন্নত দেশে বেগমপাড়া তৈরি করেছে। সর্বোপরি গুম, খুন ও আয়নাঘর তৈরির মাধ্যমে সারা দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল, তা মানুষের হৃদয়ের গহিনে ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হয় এবং একসময় দাবানলের সৃষ্টি করে। একটি দেশের জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে, সেই দেশের মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন এবং এসব সম্পদ বিদেশে পাচার আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
কয়েক বছর ধরে ব্যাপক প্রচার পাওয়া অর্থ পাচারের হিসাব এখন প্রায় সবারই জানা। সেইসঙ্গে এটাও বোঝা কঠিন ছিল না যে, পাচার রোধ করা কিংবা পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যাপারে বিগত সরকারের কোনো সদিচ্ছা ছিল না। সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা থাকলে কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব ছিল না।
এগমন্ট গ্রুপের (বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম) সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এই গ্রুপের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে অর্থ পাচার সংক্রান্ত সব তথ্য পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু সেই সুবিধাটুকু কখনো নেওয়া হয়নি। যোগাযোগ করা হয়নি পাচারকৃত অর্থের সহজ গন্তব্য সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দুবাই, কানাডা, ব্রিটেন বা অন্য কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে।
সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এস আলম গ্রুপের সম্পত্তি কেনা নিয়ে দেশের সংবাদমাধ্যমে আরও নিবিড় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটির আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা দেশে-বিদেশে এই গ্রুপের সম্পদের তথ্য চেয়েছে বিএফআইইউর কাছ থেকে। এই উদ্যোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশের তরফ থেকে বিভিন্ন দেশের সরকারের সহযোগিতা চাওয়া হলে নিশ্চিত কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে।
এখানে উল্লেখ করা উচিত, ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের অভিযান চালিয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চালানো হয়। ব্যাপক এই অভিযানে ১০০ কোটি সিঙ্গাপুরি ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ ও নগদ মুদ্রা জব্দ করা হয়েছিল বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর প্রচারিত হয়। সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগের পর আমাদের সরকার দেশটির কাছ থেকে সহায়তা নিতে পারে।
আমরা মনে করি, বর্তমান সরকার যেহেতু দেশে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এ কারণে আর্থিক খাতে সুশাসনের চরম ঘাটতিগুলো দূর করতে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। দেশের পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ-সম্পদ ফেরত আনা এই অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে।