ক্রিস ডয়েল
প্রকাশ : ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসরায়েলের আগ্রাসনে সিরিয়ায় নতুন সংকট

ইসরায়েলের আগ্রাসনে সিরিয়ায় নতুন সংকট

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল পরিস্থিতির কেন্দ্রবিন্দু ইসরায়েল, গাজা ও লেবানন। তবে সিরিয়া এ অঞ্চলের সেসব দেশগুলোর একটি, যেগুলো এ যুদ্ধাবস্থার ভেতর থেকেও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েল সিরিয়ার ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে আসছে। এ আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল হিজবুল্লাহকে আধুনিক অস্ত্রের জোগান পাওয়া থেকে বিরত রাখা। কিন্তু বর্তমানে শুধু এটিই ইসরায়েলের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়; আক্রমণ চালানোর আরও নতুন কারণ তৈরি হয়েছে।

ইসরায়েল ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন জায়গাগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। এ হামলা বিশেষ করে ২০১৭ সালের পর থেকেই শুরু হয়েছে। দামাস্কাসে ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যগুলোর একটি ছিল ইরানের দূতাবাস, যার জের ধরে পরবর্তীকালে এপ্রিল মাসে ইরান ইসরায়েলের ভূখণ্ডে পাল্টা বোমা হামলা চালায়। ইরানের দূতাবাস দামাস্কাসের আল মেজ্জেহ অঞ্চলে অবস্থিত। এসব জায়গায় ইসরায়েলি আক্রমণের দরুন সিরিয়ার অনেক নাগরিক রাজধানী ছাড়তে বাধ্য হয়।

ইসরায়েল সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন গোলান উপত্যকা ধীরে ধীরে নিজ দখলে নিয়ে যাচ্ছে। এ জায়গার ভূগর্ভস্থ সব ল্যান্ডমাইন তারা উৎখাত করেছে। পাশাপাশি তারা সিরিয়ার সঙ্গে তৈরি করেছে অসামরিকীকৃত এলাকার নতুন সীমানা। তাদের দাবি, এ নতুন কর্মপরিকল্পনার উদ্দেশ্য ইরান ও তার মদদপুষ্ট বাহনীগুলোকে ইসরায়েলের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দূরে রাখা। ইসরায়েল ঘোষণা দিয়েছে, তারা দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়ার কুনেইত্রা শহরে এক হিজবুল্লাহ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।

লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ সিরিয়ানদের জন্য বেগতিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ৪ লাখ ২৬ হাজারের অধিক সিরিয়ান এবং লেবানিজ সীমানা পাড়ি দিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছে। ২০০৬ সালেও এভাবে একবার সিরিয়ায় শরণার্থী হয়ে প্রবেশ করেছিল লেবানিজরা। তবে এবার পার্থক্যটা এই জায়গায় যে, যারা এই মুহূর্তে সিরিয়ায় প্রবেশ করছে, তাদের প্রায় ৭০ শতাংশ সিরিয়ান শরণার্থী। তারা বাধ্য হয়ে এমন এক রাষ্ট্রে প্রবেশ করছে, যেই রাষ্ট্রের সামর্থ্য নেই তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার। এ ফিরতি মানুষগুলো প্রায় সবাই দরিদ্র। তারা কোনো অর্থকড়ি নিয়ে সিরিয়ায় ফিরছে না। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ ফিরতি জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ পরিবার-পরিজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে এটি একটি স্বল্পমেয়াদি সমাধান, কেননা স্থানীয়দের দীর্ঘকাল আতিথেয়তার সামর্থ্য নেই। সিরিয়ার নিজস্ব অর্থনীতিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। দেশে ব্যাপক হারে ঘটছে মুদ্রাস্ফীতি, বিশেষ করে জ্বালানির দাম হয়ে যাচ্ছে গগনচুম্বী।

লেবাননে চলমান ইসরায়েলি হামলার দরুন এটা আন্দাজ করা অসম্ভব হয়েছে যে, লেবানিজরা আর কতদিন ধরে সিরিয়ায় অবস্থান করবে এবং আরও কত শরণার্থী সীমানা পাড়ি দিয়ে সিরিয়ায় প্রবেশ করবে। অধিকন্তু লেবানিজ ও সিরিয়ানদের রয়েছে নিজস্ব রাজনৈতিক বোঝা। যেসব লেবানিজ সিরিয়ায় প্রবেশ করছে, তাদের বৃহৎ একটা অংশ হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত এলাকার অধিবাসী। এ কারণে লেবানন ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এর ফলে সিরিয়ায় প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক লেবানিজকে দামাস্কাসের বাইরে শিয়া অধ্যুষিত এলাকা সাইয়িদাহ জাইনাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রায়ই সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন রকমের উত্তেজনা। হাসান নাসরুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের পরও এলাকায় কোনো দোকান বন্ধ করা হয়নি বিধায় হোমসে অবস্থানরত কিছু লেবানিজ ক্ষুব্ধ হয়েছে।

ফিরতি সিরিয়ানদের বাসস্থান এবং কর্মসংস্থানের বিষয়ে সিরিয়ার সরকার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেক পুরুষের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার বয়স রয়েছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা এড়াতেই অনেক সিরিয়ান শরণার্থী হয়ে লেবাননে বসবাস করত। অগত্যা এখন তাদের দেশে ফিরতে হচ্ছে। সামরিক সেবায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করলে, এত মানুষকে সাজা দেওয়া বা আটকে রাখা কর্তৃপক্ষের দ্বারা সম্ভব নয়। যেহেতু বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা নেই, সেহেতু সিরিয়ার বর্তমান সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ডের প্রচারণা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। তাই তারা জোরপূর্বক সামরিক সেবায় নিয়োগ বৃদ্ধি করতে উদ্যত হয়েছে। যারা আগে সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় কর্মত্যাগ করেছে, তাদের নিজ নিজ পদে ফেরার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। অন্যদের নতুন করে যোগদানের জন্য দুই সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছে। যাদের সেবা থেকে অব্যাহতির অনুমতি রয়েছে, তাদের নানান জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কেউ অসম্মতি জানালে তাদের শত্রুনিয়ন্ত্রিত এলাকায় ফিরতে অথবা দেশত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।

সিরিয়ার মানবসম্পদ এখন বিপদগ্রস্ত। সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পুরুষের সংখ্যা প্রয়োজনের থেকে অত্যন্ত কম, আবার সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন এলাকায় পুরুষের সংখ্যা অত্যধিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বস্তুত সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন নেই, বরং প্রয়োজন এ পুরুষদের উৎপাদনশীল অর্থনীতিতে যোগ দেওয়ার। নিজ নিজ পরিবারের হাল ধরে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করা প্রয়োজন।

ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে দক্ষিণ ইউরোপে বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এ সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি।

সিরিয়ার সরকার এ পরিবর্তনগুলোকে কীভাবে দেখছে? অদ্ভুতভাবে অনেক ঘটনাতেই তারা নীরবতা অবলম্বন করছে। সরকারি গণমাধ্যমগুলো ইয়াহিয়া সিনওয়ারের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এড়িয়ে গেছে। গোলান উপত্যকায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়েও বিশেষ আলোচনা হয়নি।

লেবাননের উত্তাল পরিস্থিতি সিরিয়ার জন্য একই সঙ্গে একটি হুমকি এবং একটি সুযোগ। তারা চিরকালই অর্থনৈতিকভাবে লেবাননের ওপর নির্ভরশীল, কাজেই যুদ্ধের পরিণাম সিরিয়াকেও ভোগ করতে হবে। কিন্তু লেবাননে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কার্যক্রম শেষ হয়ে গেলে, হয়তো সিরিয়া এখানে আবার নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস চালাবে। ২০০৫-এ সিরিয়াকে বাধ্য হয়ে লেবানন থেকে নিজস্ব সেনা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, তার আগ পর্যন্ত লেবাননে সিরিয়া বিপুল রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। যদিও এখন ১৯৯০-এর দশকের মতো সেরকম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য সিরিয়ার নেই, তবুও সিরিয়া লেবাননের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে।

অনেক সিরিয়ান পর্যবেক্ষক ধারণা করছেন, বাশার আল-আসাদ ইরান এবং হিজবুল্লাহর পক্ষ নিয়ে ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন শত্রুতার সূচনা করতে চাইছেন না। তেহরান এবং তার সহযোগী যোদ্ধাদের সংগঠনের সাহায্য এখন আর সিরিয়ার প্রয়োজন নেই, বরং ইসরায়েলের সঙ্গে শত্রুতা না করাই আসাদ নিজের জন্য বেশি কল্যাণকর বলে মনে করছেন। এদিকে হিজবুল্লাহ দাবি করছে, তাদের ৫ হাজার ৪০০ জন যোদ্ধা বাশার আল-আসাদের শাসন কায়েম রাখতে প্রাণ দিয়েছে। তাই তারা এ যুদ্ধে সিরিয়ার সমর্থন কামনা করে।

দামাস্কাসের বর্তমান শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ইসরায়েলও কোনো বড় শত্রুতায় জড়াচ্ছে না। আসাদ শুধু ফাঁকা বুলি ছাড়ার ভেতরই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে, তাতেই তারা সন্তুষ্ট। অতীতে লেবানন এবং সিরিয়ার মধ্যে যখন এক দেশ যুদ্ধাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে, তখন অন্য দেশ তার নাগরিকদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুকাল ধরে দুটো দেশ একই সঙ্গে সংকটের মুখে ধাবিত হচ্ছে। লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণ ও দখল এবং সামনে নিরাপত্তাহীন এ দুটো দেশের জন্যই হানিকর বলে প্রমাণিত হবে।

লেখক: আরব-ব্রিটিশ সমঝোতা পরিষদের পরিচালক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে : এলডিপি মহাসচিব

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ডানা, পশ্চিমবঙ্গের ৮ জেলায় স্কুল বন্ধ

‘শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আইজিপির কাছে’

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে খুমেক হাসপাতাল, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেবা

জনবল নেবে সেভ দ্য চিলড্রেন, থাকছে না বয়সসীমা

নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’য় পরিণত

প্যারিসে ফিলিস্তিনপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভ

পটুয়াখালীতে নারীসহ যুবলীগ নেতা আটক

পপুলার ফার্মায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

পুতিন-মোদি বৈঠক, পারস্পরিক সাহায্যে জোর

১০

বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, উত্তাল সাগর

১১

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

১২

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

তেলবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ

১৪

২৩ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

১৫

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৬

‘সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে’

১৭

ইউএনএফপিএ এবং জাপান সরকারের মাঝে ৪০ কোটি টাকার সহায়তা চুক্তি

১৮

‘রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে কোনো চক্রান্ত করার সুযোগ দেওয়া হবে না’

১৯

বুলগেরিয়ায় পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

২০
X