আমার দুই সন্তান। বড় মেয়ের বয়স ছয় বছর। আর ছেলের দুই বছর। বড় মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। তার স্কুলে টিফিন থেকে শুরু করে খাবার নিয়ে আমার চিন্তা বাড়ছেই। কী খেলে তার শরীর ভালো থাকবে, খরচ কম হবে, খেতে ভালো লাগবে—এসব নিয়েই আমার মতো অনেক বাবার চিন্তা। সেটা স্বাভাবিকও বটে। কারণ হচ্ছে শিশুর খাদ্যাভ্যাস। আজ আমরা আমাদের শিশুদের যা খাওয়াচ্ছি তা কতটা মানুষ্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণীয়, তা বিরাট প্রশ্ন। খাবার যদি নিরাপদ না হয়, তাহলে তা শরীরের সুস্থতার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে পড়ে। কারণ খাবারে সামান্য গরমিল হলেই সেখান থেকে পেটের পীড়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এটা সত্য, সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে শিশুকে আমরা নানা ধরনের খাবারের প্রতি অভ্যস্ত করে তুলছি, যা পুষ্টিকর তো নয়ই; বরং অনেক ক্ষেত্রে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। তা ছাড়া আমরা কী খাচ্ছি? কী খাওয়াচ্ছি? আপনি আদর করে আমার পাতে কী তুলে দিচ্ছেন? এক কথায় উত্তর হচ্ছে ভেজালযুক্ত খাবার। ভেজালযুক্ত খাদ্য থেকে আমি আপনি মুক্তি চাইলেও যেন কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছি না। তবে এক দিনে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি, অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিদের ফলে মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
গত ১৬ অক্টোবর ছিল বিশ্ব খাদ্য দিবস। বিশ্বব্যাপী সচেতনতা, ক্ষুধার মোকাবিলা এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করার সংকল্পকে উদ্দেশ্য করে এই দিনটি পালিত হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল—উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার। অবশ্যই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বছর দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা খাদ্যের অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। শুধু তাই নয়, অন্যান্য মানবাধিকার পূরণের জন্যও খাদ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ অপরিহার্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে সব নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবন-ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা; আবার সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে জনগণের ‘পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে’। সেই হিসেবে এমন একটি দিনে বাংলাদেশ নতুন করে প্রতিজ্ঞা নিতে পারে, যেন আগামী দিনগুলোয় সবার মুখে নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য তুলে দেওয়ার সংস্থান সে করতে পারে।
শুরুতে বলেছি, আমি আমার সন্তানের স্কুলে টিফিন থেকে শুরু করে খাবার নিয়ে চিন্তিত। প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে, আমরা জেনে-শুনে বিষ মুখে তুলে দিচ্ছি। এমন কোনো খাদ্যপণ্য নেই যেটি নির্ভয়ে ও নিঃসংকোচে খেতে দিতে পারি। শুধু সন্তান কেন? আমরা কী খাচ্ছি? কেন খাচ্ছি? রাষ্ট্রের কাছে আজ বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিষয়টি। কিছু সুবিধাভোগী মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ। যারা বিভিন্নভাবে সুবিধা নিয়ে মানহীন খাবার তুলে দিচ্ছে আমাদের মুখে। আমরা বেঁচে থাকার জন্য খাই; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এসব নোংরা খাবারের জন্য বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হচ্ছে মানবদেহে। যার ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে সহজ-সরল জনগণ। তাই কর্তব্য অবহেলার জন্য রাষ্ট্র কখনো দায় এড়াতে পারে না।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সুস্থ-সবল জাতি গঠন এবং সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। শিশুরা যদি স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার না খায়, তাহলে তারা ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে না; বরং কোনো রকমে বেঁচে থাকে। এ কারণেই ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড’ বা শিশুর অধিকারবিষয়ক সনদে ঘোষণা করা হয়েছে, প্রতিটি শিশুরই স্বাস্থ্যকর খাবার ও পুষ্টি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। প্রকৃতি থেকে আহরিত খাদ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু অধিক মুনাফার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা তাদের বিবেক বিসর্জন দিয়ে খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, মাছ থেকে শুরু করে ফলমূল, চিপস, শিশুখাদ্য, জুস সবখানেই ভেজালের ছড়াছড়ি। নিরাপদ খাবার যেন কোথাও নেই।
আসলে খাদ্যপণ্যে ভেজাল আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০ শতাংশ খাদ্যে রাসায়নিক ও ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের ৩৩ শতাংশ রোগের মূল কারণ ভেজাল খাদ্য। মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এই সমস্যা শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করছে না; বরং জাতীয় উন্নতিও বাধাগ্রস্ত করছে। কারণ খাদ্যে ভেজাল অসংখ্য জীবনঘাতী ও দীর্ঘস্থায়ী রোগের প্রাদুর্ভাব জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করছে। ভেজাল খাদ্যের কারণে ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি ইত্যাদি জটিল রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উপরন্তু ভেজাল খাদ্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে খাদ্যের কারণে সৃষ্ট গন্ডগোলের পর নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা ওঠে। জনগণও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কিন্তু প্রশাসন একেবারে বসেও থাকে না। বিভিন্ন দোকান, হোটেল, সুপারশপে অভিযান চালায়। কয়েক ঘণ্টায় কয়েক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গণমাধ্যমে সে খবর নিয়ে আমরা জনতা একটু কথাবার্তা বলি। তারপর আবার যা তা-ই। মাঝখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে কিছু অর্থকড়ি জমা হয়; কিন্তু আমজনতার পোড়া তেলের মতোই ‘পোড়া কপাল’। এত পোড়ে, তা-ও শেষ হয় না। ২০১৩ সালে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন পাস করে।
এরপর ২০১৫ সালে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সংস্থাটি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পেরেছে ২০২০ সাল থেকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ খাবারের ব্যাপারে সর্বপ্রথম সচেতনতা শুরু হওয়া উচিত নিজেদের ঘর থেকে। কারণ, রান্না করা বা কাঁচা খাবার কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয়, খাবারের বিষক্রিয়া এড়াতে করণীয় কী, একই খাবার বারবার রান্না করলে খাবারের গুণমান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কি না—এ রকম আরও নানা বিষয়ে যদি মানুষ শুরু থেকেই সচেতন থাকে, তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ এড়ানো সম্ভব।
খাবার নিরাপদ রাখতে যেসব পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তার মধ্যে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখা, খাবার ভালোভাবে রান্না করা, খাবারকে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখা এবং রান্নার সময় নিরাপদ পানি ও নিরাপদ কাঁচামাল ব্যবহার করা।
সরকারের যেসব সংস্থা, যারা বিভিন্ন অনুমতি দিয়ে থাকে, তাদের ঠিকমতো কাজ করতে হবে। যদি কোনো ক্রেতার কোনো খাবার অনিরাপদ মনে হয়, তবে তারা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিসে সরাসরি এসে কিংবা ইমেইলে অভিযোগ জানাতে পারে। তা ছাড়া সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেওয়া বিভিন্ন জেলার কর্মকর্তাদের ফোনেও অভিযোগ জানাতে পারবে। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার আমাদের সচেতনতা।
এবার খাদ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। পর্যাপ্ত খাদ্য জোগানের প্রচেষ্টায় দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। জমিতে কীটনাশকের প্রয়োগ কমিয়ে সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করাই আগামী লক্ষ্য হওয়া উচিত।
ভোক্তাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা সচেতন না হলে শুধু আইন করেও খাদ্যপণ্য ভেজালমুক্ত করা সম্ভব নয়। ভেজাল রুখতে হলে মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই ভোক্তা। উৎপাদক-ব্যবসায়ী থেকে ভোক্তা—সবার সচেতনতার বিকল্প নেই।
লেখক: কৃষিবিদ, উপপরিচালক
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়