ইব্রাহিম আল-মারাসি
প্রকাশ : ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১২ এএম
আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত পাল্টা বিপর্যয় ঘটাবে

ইরানের পরমাণু স্থাপনায় আঘাত পাল্টা বিপর্যয় ঘটাবে

ইসরায়েল হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে বৈরুতে এবং হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে তেহরানে হত্যার পর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ইরান ১ অক্টোবর ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপর থেকেই পর্যবেক্ষকরা ধারণা করার চেষ্টা করছেন যে, কী হতে পারে তেল আবিবের পাল্টা প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বলছেন, ইসরায়েল ইরানের তেলের স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালাবে; আবার কেউ বলছেন, আক্রমণের নিশানা হবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো।

এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন দুটির কোনোটিতেই আক্রমণ চালানোর পক্ষপাতী নয় বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ইরানের প্রতিক্রিয়ামূলক আক্রমণের আশঙ্কায় ইসরায়েলে মার্কিন সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছে। পাশাপাশি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে একটি ‘টার্মিনাল হাই অ্যালটিটুড এরিয়া ডিফেন্স’ (থাড) মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপনেরও।

অন্যদিকে বাইডেনের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলকে উৎসাহিত করছেন ‘ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আগে’ আক্রমণ চালাতে। তার জামাতা জ্যারেড কুশনারও একই মতামত প্রকাশ করেছেন।

যদিও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলার ব্যাপারে ট্রাম্প, কুশনার এবং ইসরায়েলের অন্য দৃঢ় সমর্থকরা উৎসাহ প্রকাশ করছেন, তবে তারা খুব সম্ভবত ইসরায়েলের আরও একটি ভয়াবহ হামলার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন। সেটা হচ্ছে—ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ইসরায়েলের হামলার পরবর্তী ফল কী হতে পারে।

১৯৮১ সালে ইসরায়েল ইরাকে ফরাসিদের নির্মিত ‘অসিরাক’ পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস করে দেয়। এই চুল্লি ছিল মূলত একটি গোপনীয় শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ। সেই আক্রমণের ঘটনাই পরবর্তী সময়ে ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে পারমাণবিক অস্ত্রের জোগাড় করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইরানের পারমাণবিক পরিকল্পনার ওপর হামলা চালালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে।

একটি স্বতঃপ্রণোদিত আক্রমণ

গত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইরাকের পারমাণবিক কার্যক্রম শুরু হয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ইরাককে একটি ছোট গবেষণামূলক পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ করে দেয় এবং তা পরিচালনার জন্য কিছু প্রযুক্তিগত জ্ঞান সরবরাহ করে। এরপর সত্তরের দশকে ইরাক ফ্রান্সের থেকে অসিরারক নামের একটি বড় চুল্লি ক্রয় করে এবং ফরাসি ও ইতালীয়দের সহায়তায় তাদের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি সম্প্রসারণ করে।

ফ্রান্সের সরকার অসিরাকের এমন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করে যেন চুল্লির কোনো বৈকল্পিক ব্যবহারের সুযোগ না থাকে এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও পৌঁছে দেয়। ইরাক পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নিয়মিত ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পর্যবেক্ষণ করত। ইসরায়েলের দাবি ছিল যে, ইরাক ‘পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের দ্বারপ্রান্তে’ পৌঁছে গেছে। তবে এটি ছিল মূলত একটি ভিত্তিহীন দাবি।

এর পরও ইসরায়েল সরকার একটি স্বপ্রণোদিত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। বস্তুত এই সরকারের প্রতি তখন বেড়ে চলছিল ইসরায়েলবাসীদের অসন্তোষ এবং আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ছিল তাদের ক্ষমতা হারানোর সমূহ সম্ভাবনা।

১৯৮১ সালের ৭ জুন মার্কিনদের তৈরি কিছু এফ-১৫ ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইসরায়েল থেকে যাত্রা শুরু করে। এরা উড়ন্ত অবস্থায় জ্বালানি সংগ্রহ করে ইরাকের অসিরাক চুল্লিতে হামলা চালায় এবং স্থাপনাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণের দরুন তিনজন ইরাকি নাগরিক ও একজন ফরাসি প্রকৌশলী নিহত হন।

এ হামলার ঘটনা ইসরায়েলি নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী মনোভাব দৃঢ় করে তোলে এবং তিন সপ্তাহ পর প্রধানমন্ত্রী মেনাশেম বেগিনকে অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে পুনর্নির্বাচিত হতে সাহায্য করে।

২০২১ সালে উন্মোচিত মার্কিন নথিপত্র থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ইসরায়েলের আক্রমণে ইরাকের পারমাণবিক কর্মসূচি নির্মূল হয়নি, বরং এই আক্রমণ সাদ্দামকে পারমাণবিক অস্ত্র সংগ্রহে আরও বেশি সংকল্পবদ্ধ করে তোলে।

এ ঘটনা অনেক ইরাকি বিজ্ঞানীকেও নিজ দেশের পারমাণবিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ইরাকি পারমাণবিক বিজ্ঞানী জাফর ধিয়া তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন—‘টাম্মুজে (অসিরাক) ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তারা মূলত মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রের একাধিপত্য দমন করতে অংশগ্রহণের জন্য রীতিমতো সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।’ এ বিজ্ঞানীরাই পরবর্তী সময়ে সাদ্দামের জন্য আক্রমণে হারানো সেই যন্ত্রপাতি এবং পারমাণবিক চুল্লির চেয়ে বেশি মূল্যবান প্রমাণিত হয়েছিল।

পরবর্তী বছরগুলোতে সাদ্দামের শাসনে পারমাণবিক কার্যক্রম গোপনীয় করে তোলে। পাশাপাশি তার সরকার পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদনের সক্ষমতা উন্নয়নে সহযোগিতা পাওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তানের মতো পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তারা ধ্বংস হয়ে যাওয়া চুল্লিটিও পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালায়।

এই উদ্যোগ ১৯৯০ এর দশকের প্রথম দিকে প্রথম পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের দরুন বাধাগ্রস্ত হয়। এ যুদ্ধ ইরাকের অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয় এবং যুদ্ধ-পরবর্তী নিষেধাজ্ঞাগুলো রাষ্ট্রের কোষাগারকে করে তোলে শূন্য।

ইরানে হামলা চালানোর পরিণতি

বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানী খুন হয়েছেন। সম্প্রতি ২০২০ সালের নভেম্বরে একজন পারমাণবিক পদার্থবিদ এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির উচ্চপদস্থ সদস্য মোহসেন ফাখরিজাদেহ তেহরানের কাছে অতর্কিত হামলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। ইরান এই হত্যাকাণ্ড ও অতীতে অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েলকে দোষী বলে চিহ্নিত করেছে।

যদিও এ হত্যাকাণ্ডগুলোতে পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। তবে তাদের মৃত্যু ইরানের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে এবং তাদের পারমাণবিক বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ক্রমাগত হামলার ফলস্বরূপ উদ্ভব ঘটেছে ইরানের ‘পারমাণবিক জাতীয়তাবাদ’-এর।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পরবর্তী ঘটনাবলি এ আবেগকে আরও উজ্জীবিত করেছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, একটি শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে ইরানের জনগণের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং এখন জনসাধারণের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের প্রতি আগ্রহ অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় ৬৯ শতাংশ মানুষ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পক্ষপাতী।

স্পষ্টতই ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সংকল্প বাড়িয়ে দিচ্ছে। ইরানের যে কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা সেই সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে তুলবে। ইরাকের উদাহরণ অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে বলা চলে যে, ইসরায়েলের আক্রমণ মোকাবিলায় ইরান তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ইরাকের মতো গোপনীয়তা অবলম্বন করে চালিয়ে যেতে পারে এবং ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়নের প্রক্রিয়া আরও ত্বরান্বিত করতে পারে।

ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এ মুহূর্তে তার পূর্বসূরি বেগিনের অবস্থানে রয়েছেন। তিনি এমন একটি সরকার পরিচালনা করছেন, যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনাসহ আরও বিভিন্ন ব্যর্থতার জন্য ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন। ইসরায়েলের জনসাধারণকে একটি ‘বিজয়’ এনে দেওয়ার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু গাজা ও লেবাননে নেতানিয়াহু এখন যা করছেন এবং ইরানে পরবর্তী সময়ে যা করার পরিকল্পনা করছেন, তা ইসরায়েলকে কোনো বিজয় এনে দেবে না। বরং তার রাজনীতির কৌশল এ দেশগুলোর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশেও সাধারণ জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করছে। এই ক্ষোভ ইরান ও তার মিত্রদের সুযোগ করে দেবে ক্ষতিপূরণ করে নেওয়ার। একই সঙ্গে ইসরায়েলের আক্রমণের পর প্রয়োজনীয় পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করে নেওয়ারও সুযোগ করে দেবে।

লেখক: মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, স্যান মারকোস।

প্রকাশিত নিবন্ধটি আলজাজিরায় মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজ ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে : এলডিপি মহাসচিব

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ডানা, পশ্চিমবঙ্গের ৮ জেলায় স্কুল বন্ধ

‘শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আইজিপির কাছে’

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে খুমেক হাসপাতাল, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেবা

জনবল নেবে সেভ দ্য চিলড্রেন, থাকছে না বয়সসীমা

নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’য় পরিণত

প্যারিসে ফিলিস্তিনপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভ

পটুয়াখালীতে নারীসহ যুবলীগ নেতা আটক

পপুলার ফার্মায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

১০

পুতিন-মোদি বৈঠক, পারস্পরিক সাহায্যে জোর

১১

বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, উত্তাল সাগর

১২

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

১৩

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৪

তেলবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ

১৫

২৩ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

১৬

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৭

‘সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে’

১৮

ইউএনএফপিএ এবং জাপান সরকারের মাঝে ৪০ কোটি টাকার সহায়তা চুক্তি

১৯

‘রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে কোনো চক্রান্ত করার সুযোগ দেওয়া হবে না’

২০
X