পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর, বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে মহাপরাক্রমশীল আওয়ামী লীগ। সতর্কভাবে ঘুঁটি সাজাতে থাকে ঐতিহ্য়বাহী একাধিক বাম-ডান সংগঠন। এরই মধ্যে এক জেনারেলের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ছিল রীতিমতো বিস্ময়ের। সে সময়ের উদ্ভ্রান্ত রাজনীতি ছিল বিভ্রান্ত জাতির কাছে সর্বনাশা কৌতূহল। হত্য়াকাণ্ডের শিকার হলেও রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব তখনো চলমান। তার প্রভাবশালী ব্য়ক্তিত্ব রাজনীতিতে অনস্বীকার্য। এ ছাড়া বাঘা বাঘা বাম ও ডান নেতা সক্রিয় দাবার অভিজ্ঞ চাল নিয়ে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রথমে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক দল-জাগদল। পরে আরও গবেষণা ও সংস্কারের পর গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। রাষ্ট্রপতি ও দলীয়প্রধান জিয়াউর রহমানের আহ্বানে এ নতুন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী পতাকা তলে দলে দলে যোগ দেয় বাম, ডান, মধ্যপন্থি সব ধরনের মানুষ। প্রায় ৪৫ শতাংশ তরুণ সদস্য রাজনীতিতে নাম লেখায়। জিয়ার জাদুকরী নেতৃত্বে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পায় বিএনপি। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ হলেও সফল সমরনায়ক ঝানু রাজনীতিবিদদের জড়ো করেন তার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে। জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমান মনে করতেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক ভূখণ্ডের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ‘বাংলাদেশি’ পরিচয়, যা বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি জনগণকে ভারতের বাঙালি থেকে আলাদা করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্য়তম নায়ক জিয়া হয়ে ওঠেন জাতির মুক্তির নায়ক। বিএনপি শুরুতে বাম-ডান রাজনৈতিক মিশ্রণে একটি বৃহৎ পরিসরে বিভক্ত ছিল। তাই জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক মতবাদের একটি সাধারণ উপাদান হিসেবে সামাজিক ন্যায়বিচারকে উপস্থাপন করেন তিনি। ইসলামী ও রক্ষণশীল ধারা বিএনপির আদর্শের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রক্ষণশীলতার প্রতি তাদের অবস্থান ‘প্রথাগত বাঙালি রীতিনীতি ও মধ্যপন্থি ইসলামের মিশ্রণকে প্রতিনিধিত্ব করে’। দলটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একটি উপাদান হিসেবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতাকেও প্রচার করে। দলের অনেক প্রতিষ্ঠাতা নেতা ছিলেন অমুসলিম। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা হিসেবে ধর্মতন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এক কর্মশালা উদ্বোধনকালে দলের কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনোই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ তার এই উদার ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি বিএনপিকে দ্রুত এনে দেয় আন্তর্জাতিক ভিত্তি। তবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা এই পুরুষকে প্রতিনিয়ত যুঝতে হয়েছে দল এবং দলের বাইরে। দ্রুত সাফল্য পাওয়া দলের সুফল ভোগ করতে মরিয়া ছিল নেতাকর্মীরা। দেশ-জাতির ঐক্য়ের প্রয়োজনে নানা মত-পথের মানুষ জড়ো করেছিলেন জিয়া। কিন্তু ব্য়ক্তিস্বার্থে ডাকসাইটে নেতারা বারবার কোটারিভুক্ত হয়ে পড়েছেন। জীবনের শেষ দিনও জিয়াউর রহমান ব্য়স্ত ছিলেন দলীয় কোন্দল মেটাতে। বিএনপি প্রতিষ্ঠার মাত্র আড়াই বছরের মাথায় হত্য়াকাণ্ডের শিকার হন এই ক্য়ারিশমেটিক দলীয় প্রধান ও মেধাবী রাষ্ট্রনায়ক। ২৫ বার সেনা ক্য়ু ঠেকাতে সক্ষম হলেও শেষবার বুক তার ঝাঁজরা হয়ে যায় দেশি-বিদেশি চক্রান্তে। তার মৃত্য়ুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দল ও দেশের হাল ধরেন। কিন্তু অতি সাধারণ মানের ব্য়ক্তিত্ব দিয়ে কোনোটাই ধরে রাখতে পারেননি তিনি। সে সময়ের সেনাপ্রধান ও পরে স্বৈরাচারী এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। তখন রাতারাতি বিএনপি ছেড়ে যান গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। ততদিনে শহীদ জিয়ার দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। তৃণমূলের দাবির মুখে গৃহিণী বেগম খালেদা জিয়া হাল ধরেন বিএনপির।
গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, ‘জিয়াউর রহমান ক্ষমতার বলয়ের ভেতরে থেকে দল তৈরি করেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়া সে দলকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নেন। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির গড়ে ওঠা এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নিবার্চনে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তাকে কয়েকবার আটক করা হলেও আন্দোলন থেকে সরে যাননি এ আপসহীন নেত্রী। জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি তিনি। খালেদা জিয়া নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রগতিশীল ধারা থেকে দলটি সরে আসতে থাকে। বেগম জিয়াকে যেন ক্রমশ আপস করতে দেখা গেছে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতিমাত্রায় যোগাযোগ এবং আপসের ফলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।’
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলো খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বলে অনেকের ধারণা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও দলের ভেতরে নানা টানাপোড়েন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রের প্রতি খালেদা জিয়ার অবিচল আস্থা ছিল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে তার ক্যারিশমা রয়েছে। ২০০১-২০০৬ সালে কিছু দুষ্টু লোক শাসন পদ্ধতিতে ঢুকে কিছু কিছু কাজকর্ম করেছে যেটার দায় গিয়ে তার ওপর পড়েছে।’
এক-এগারোর পটপরিবর্তনের জেরে উদ্দেশ্য়মূলক মামলায় আটক হয়েছেন খালেদা জিয়া। পরবর্তীকালে সেই মামলায় আওয়ামী ফ্য়াসিস্ট শাসনামলে সাজা ভোগ করেছেন তিনি। উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব নিয়ে দিনের পর দিন স্য়াঁতসেঁতে কারাগারে থেকেছেন এ মহীয়সী নারী। ছাত্র-জনতার অভ্য়ুত্থানের পর রাষ্ট্রযন্ত্রের আলো পড়ে তার ওপর। আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তার সাজা মওকুফ করা হয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য়ে করা তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রদ্রোহ, মানহানির মামলা রয়েছে ৩০টির ওপর। সম্প্রতি পাঁচ মামলায় তিনি খালাস পেলেও বাকিগুলো একইভাবে আছে।
দেশের রাজনীতির আরেক ট্র্য়াজিক হিরো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্য়ান তারেক রহমান। থানা পর্যায় থেকে সদস্য় পদ নিয়ে ধাপে ধাপে নিজেকে পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে তুলছিলেন তিনি। সারা দেশ চষে বেড়ানো তৃণমূলের তুমুল জনপ্রিয় এই আধুনিক তরুণের মধ্যে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা জিয়ার ছায়া দেখছিলেন। ততদিনে তার ভবিষ্য়ৎ আকাশে শকুনের ছায়া পড়ে। ফ্য়াসিস্ট সরকারের পরিকল্পনাকারী দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা ও গোয়েবলসীয় মিডিয়া মাঠে নামে। তাকে ঘিরে রাখা উমেদার চক্র পাল্টা জবাব দিতে ব্য়র্থ হয়। তার বিরুদ্ধে ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৭টি মামলা হয়। সে সময় ১৮ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন তিনি। ২০০৮ সালে দুঃখজনকভাবে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। পরবর্তী সময়ে হাসিনা সরকারের সময়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা (যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত), অর্থ পাচার এবং মানহানিসহ আরও ২০টির বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি মামলার বিচার শেষে সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। আর কিছু মামলা স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। ৫ আগস্টের পর কিছু মানহানির মামলায় খালাস বা মামলা প্রত্যাহার হলেও বাকিগুলো একইভাবে আছে। মিথ্য়া মামলা ও সাজা প্রত্য়াহারের দাবিতে এখন আন্দোলন করছে তার দল। প্রবাসে থেকে প্রায় ১৭ বছর ধরে দলের ঐক্য় ধরে রাখার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। যদিও আন্দোলনের সফলতা নিয়ে নানা কথা রয়েছে। দলের কিছু সুবিধাবাদী নেতা ধারাবাহিক বেইমানি করেছেন বলে জানা যায়। ছাত্র-জনতার সফল বিপ্লবের পর তারা হামলে পড়ে দখলবাণিজ্য়ে। বেপরোয়া নেতাদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর ভূমিকা নেন তারেক রহমান। এরই মধ্যে তিনি দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। কেউ চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কাজে লিপ্ত হলে দল থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দিয়েছেন। গত আড়াই মাসে সারা দেশে সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্য়বস্থা নিয়েছে বিএনপি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সমর্থনের পাশাপাশি নিয়মিত রাষ্ট্র সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিচ্ছেন তারেক রহমান। এর পরও নিজ দলের নেতাকর্মীদের উপদ্রব, জোটসঙ্গীদের অনভিপ্রেত প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য়বিরোধী নতুন তরুণ তুর্কিদের নানামুখী প্রচারণায় প্রতিনিয়ত তৎপর থাকেন তিনি। দীর্ঘ আন্দোলনে সফলতার দ্বারপ্রান্তে এসেছে বিএনপি। নির্বাসনে থেকে ধৈর্য ধরে দলকে বিজয়ের লক্ষ্য়ে এগিয়ে নেওয়ার কঠিন কাজটি তাকে একা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ খালেদা জিয়া দলে থেকেও নেই। রোগে-শোকে পর্যুদস্ত তিনি। এই সুযোগের সদ্ব্য়বহার অসৎ উদ্দেশ্য়ে করার লোকেরও অভাব নেই।
আওয়ামী লীগের আগ্রাসী আচরণ ও অতিমাত্রায় ভারতীয় আধিপত্য়ের বিচরণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণ বিরক্ত থাকে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সততায় মুগ্ধ জাতি তাই বারবার বিএনপিতে আস্থা রাখে। সুষ্ঠু ভোট হলে ধানের শীষকে সার্বভৌমত্বের প্রতীক মনে করে। দলটি সবসময়ই নেতাকর্মীদের জন্য় সৌভাগ্য় বয়ে আনে। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে আমলা, বাহিনী ও ব্য়বসায়ীবান্ধব হয়ে ওঠে। এর জন্য় পরে কঠিন মূল্য় দিতে হয় দলটির হতভাগ্য় নেতাকে।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা