পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ডেঙ্গু সমস্যা প্রায় দুই যুগ অতিবাহিত হতে চললেও, এ ক্ষেত্রে কোনো সফলতা নেই। এটি অত্যন্ত হতাশার ও দুঃখের কথা।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে চলতি বছর এখন পর্যন্ত নতুন করে প্রায় আড়াইশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে। রোগটির প্রকোপের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। গড়ে সাত-আটজনের মৃত্যু হচ্ছে প্রতিদিন। শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তিও গড়ে হাজারের বেশি। চলতি বছর মৃতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম মানুষ, যা দুই-তৃতীয়াংশ। অর্থাৎ যাদের আয়ের ওপর নির্ভর করে পরিবার। যদিও কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়, তবুও ডেঙ্গুতে এসব কর্মক্ষম মানুষের চলে যাওয়া সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোকে যে বিশাল অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়, তা বলাই বাহুল্য।
সারা দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার জন্য মশকনিধনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু বেশি হওয়ার নেপথ্যে অবহেলা সবচেয়ে বেশি দায়ী করছেন তারা। জ্বর জ্বর অনুভব করলেও কাজ ফেলে কেউ যাচ্ছে না ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে। ফলে রোগটি নীরবে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে আক্রান্ত ব্যক্তিকে। পরিস্থিতির অবনতি হলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এলেও শেষরক্ষা হয় না।
আমরা জানি, গত দুই দশকেরও অধিক সময়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে রোগটিতে। রোগটির প্রকোপ সাধারণত শহরকেন্দ্রিক বিশেষ করে ঢাকা শহরে শুরু হলেও এখন এর বিস্তার সারা দেশে। শুধু তাই নয়, একসময় যা ছিল বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, এখন তা প্রায় সারা বছরের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ দিন দিন এর প্রকৃতি, ধরন পাল্টাচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্টাচ্ছে এটি মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে নানা উদ্যোগ, পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে এসবে বরাবরই অনুপস্থিত ছিল উপযুক্ত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দেদার টাকা খরচ, বিশেষ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে ব্যয়ের পরিমাণ চোখ কপালে তোলার মতো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আবার উদ্যোগগুলোর বেশিরভাগই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যকরও। পাশাপাশি ছিল স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব। তা সত্ত্বেও দেখা গেছে, গতানুগতিক পদ্ধতিতে মশকনিধনের নানা আয়োজন, যার বেশিরভাগই ‘লোকদেখানো’। এতে মশা বাগে না এলেও প্রতি বাজেটে যুক্ত হয় বাড়তি ব্যয়। জনগণের টাকারই শুধু শ্রাদ্ধ হয়, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতাসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশের এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সফলতার কথা অজানা নয়। আমরা মনে করি, দেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এ পরিণতির পেছনে দীর্ঘ সময় ধরে চলমান অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশক নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থাসহ সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা প্রধানত দায়ী। ফলে এটি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগের ক্ষেত্রে যেসব দেশ ডেঙ্গু মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেসব মডেল উপযুক্ত কি না এবং তা স্থায়ী সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। আমাদের প্রত্যাশা, ছাত্র-জনতার অন্তর্বর্তী সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী সমাধানের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।