ড. এ বি এম রেজাউল করিম ফকির
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৭ এএম
আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনা

জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনা

বাঙালি জাতির প্রচলিত ইতিহাসের একটি সমস্যা হলো এই যে, এই ইতিহাসে বাঙালি জাতির গর্ব ও ঐশ্বর্যের ইতিহাসটি সঠিকভাবে লিপিবদ্ধায়িত হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাঙ্গালা সালতানাতের চূড়ান্ত পতনের পর, বাঙালি জাতির কোনো জাতীয় ইতিহাস রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এর প্রধান কারণ হলো, ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ—এই চার শতাব্দীকালব্যাপী মোঘল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে বাঙালি জাতির কোনো ইতিহাস নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি বরং এই তিনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাঙালি জাতির অতীত ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই সময়ে বাঙ্গালার বহু শিলালেখ, দলিলপত্র ও গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ পর্যায়ে উল্লেখ্য যে, কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে, সেই রাজনৈতিক শক্তি পূর্ববর্তী রাজত্বকালের ঐশ্বর্যগুলোকে গোপন করতে বা মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। জাপান ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটি মেইজি বিপ্লবের পর, মেইজি সম্রাট তার পূর্ববর্তী তকুগাওয়া রাজত্বকালের অতীত অর্জনগুলো মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। তকুগাওয়া শাসনমলের প্রতি তারা এতটাই বৈরী ছিল যে, তারা তকুগাওয়া রাজত্বকালের নামই বদলে দেয়। সেজন্য তকুগাওয়া শাসনামলের নাম বদলে তারা এদো শাসনামল রাখে। এদো ছিল মূলত: তকুগাওয়া রাজত্বের রাজধানী শহর। অথচ তকুগাওয়া রাজবংশ প্রায় আড়াইশ (১৬০৩-১৮৬৮ খ্রি.) বছর জাপান শাসন করে। সে সময় তারা জাপানকে একীভূত করে একটি জাতিতে পরিণত করে এবং জাপানকে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নেয়।

আমরা জানি যে, বাঙালি জাতির সৃষ্টি হয়েছে প্রায় হাজার বছর আগে, অথচ প্রচলিত ইতিহাসে বাংলাদেশের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়ে থাকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এভাবে জাতির অতীতকে চেতনায় ধারণ না করে সর্বশেষ একটি মুক্তিযুদ্ধকে মাইলফলক ঘটনা হিসেবে নিয়ে যে রাজনৈতিক ইতিহাস নির্মাণ করা হয়েছে, তা জাতির অতীত সভ্যতা ও ঐতিহ্যের আংশিক বর্ণনা বিশেষ। তা সত্ত্বেও সংক্ষিপ্ত কালব্যাপ্তির মধ্যে এই ইতিহাস নির্মাণ করার কারণ হলো ইতিহাস বিস্মৃতি। বাঙালি জাতির এই ইতিহাস বিস্মৃতি ঘটেছে, ভিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কবলে নিপতিত হওয়ার কারণে। বস্তুত: বাঙালি এর আগে মোটামুটি চার শতাব্দীকাল ধরে মোগল সাম্রাজ্য (১৫৭৬-১৭৫৭ খ্রি.) ও দুই শতাব্দীকাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (১৭৫৭-১৯৫৭ খ্রি.) শাসনাধীনে নিপতিত ছিল। এই দুটি বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে বিনষ্ট করতে বাঙালি জাতির সভ্যতা ও ঐতিহ্যকে মুছে দিতে প্রয়াসী হয়। তারা নিজেদের ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসকে কালক্রমে বিকৃত করতে প্রয়াসী হয় এবং বাঙালি জাতির স্মারক বিভিন্ন নিদর্শন, যেমন—রাজধানী গৌড়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। বিস্ময়ের বিষয় হলো এই যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের পর, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্ত ভারতও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে, নতুন ধারার ইতিহাস নির্মাণ শুরু করে। কিন্তু বাঙ্গালার একাংশ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হলেও, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তার প্রতি বিদ্বজনের মধ্যে কোনো স্পৃহা জন্মায়নি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। উল্লেখ্য যে, চীনের হান জাতি দীর্ঘকাল মোঙ্গল সাম্রাজ্য (১২৭১-১৩৬৮ খ্রি.) ও মাঞ্চু সাম্রাজ্যের (১৬৬৬-১৯১২ খ্র.) অধীনে নিপতিত ছিল। তবে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর তারা খ্রিষ্টপূর্ব কালকে প্রারম্ভ বছর ধরে তাদের ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করে। হান জাতির ইতিহাস পুনর্নির্মাণের নজিরটিকে সামনে নিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করা উচিত। উল্লেখ্য যে, একটি জাতির ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিবৃত করতে হলে, জাতির অতীত অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঘটনা প্রবাহকে কালানুক্রমিকভাবে তুলে ধরতে হয়। বাঙালি জাতির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নির্মাণ করতে হলে প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার বছর ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দকে প্রারম্ভিক কাল ধরে অতীত কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ইতিহাসকে পুনর্লিখন করা প্রয়োজন।

ইতিহাস নির্মাণের উক্ত ধারণাগত প্রেক্ষাপটে, বাঙ্গালার ইতিহাসটি নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। চতুর্থ শতাব্দীতে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর দেশজুড়ে রাজনৈতিক শূন্যতা চলতে থাকলে, একপর্যায়ে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে বরেন্দ্রের ভূমিপুত্র গোপাল গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করে পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৬১খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সাম্রাজ্যের সম্রাটরা উত্তর-পশ্চিমে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্য (৭৩০-১০৩৬খ্রি.), দাক্ষিণাত্যে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্য (৭৫৩-৯৮২ খ্রি.) ও পশ্চিমে চালুক্য সাম্রাজ্য (৯৭৫-১১৮৪খ্রি.) এবং পূর্বাঞ্চলে বাগান সাম্রাজ্যের (৮৪৯-১২৯৭খ্রি.) বিরুদ্ধে যুজে ১১৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন। তৎপরবর্তীতে সেন সাম্রাজ্য (১০৭০-১২৩০) সহ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্বাধীনতা বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিল বটে, কিন্তু মধ্য এশিয়া থেকে নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় চিন্তা ও দর্শন নিয়ে আগত মুসলমানরা বাঙ্গালাকে শাসনে ব্যাপৃত হয়। সারা ভারতবর্ষ যখন মুসলমান শাসকদের শাসনাধীনে নিপতিত হতে থাকে, তখন শামসউদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৪৮৭ খ্রি.) নামক এক মুসলিম নেতা পাল সাম্রাজ্যে জনগণের পক্ষে ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন বাঙ্গালা সালাতানাত (১৩৫২-১৫৭৩ খ্রি.) নামক নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এই সালতানাত ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দিল্লি সালতানাত, দাক্ষিণাত্য ও বার্মার আধিপত্য থেকে বাঙ্গালার স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম হন। এই বাঙ্গালা সালতানাতের নাম থেকে এই দেশ, জাতি ও ভাষা যথাক্রমে বাঙ্গালা দেশ, বাঙালি জাতি ও বাঙ্গালা ভাষা অভিধা লাভ করে। ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির মুঘল সাম্রাজ্যের হাতে এই স্বাধীন বাঙ্গালা দেশের রাজধানী গৌড়ের পতন ঘটলে, প্রথমে মুঘল সাম্রাজ্যের (১৫৭৩-১৭৫৭ খ্রি.) অধীনে এবং পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের (১৭৫৭-১৯৪৭খ্রি.) শাসনাধীনে নিপতিত হয়। মোঘল শাসনাধীনে নিপতিত হওয়ার প্রাক্কালে বারো ভূঁইয়াদের সমর্থনে ঈশা খান (১৫৩৬-১৫৯৯ খ্রি.) পরাধীন বাঙ্গালা দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে ব্যাপৃত ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। তৎপরবর্তীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনে নিপতিত হলে এ দেশের মানুষ ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬০-১৮০০ খ্রি.), সাঁতাল হুল (১৮৫৫ খ্রি.), সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭ খ্রি.) ও নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯ খ্রি.) ইত্যাদি আন্দোলনের মাধ্যমে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, ফজলুল হক, শরৎ বসু, কিরণ শংকর রায় (১৮৯১-১৯৪৯), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ শাসনাধীন ব্রিটিশ বেঙ্গল থেকে স্বাধীন বাঙ্গালা গঠনের চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপধ্যায়, খাজা নাজিমউদ্দীন, জ্যোতি বসু ও আবুল হাশিম প্রমুখের বিরোধিতায় বাঙ্গালা দেশ স্বাধীন হতে পারেনি বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সৃষ্ট ভারত (১৯৪৭-বর্তমান কাল পর্যন্ত) ও পাকিস্তানের (১৯৪৭-১৯৭১) শাসনাধীনে নিপতিত হয়। অতঃপর ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙ্গালাবর্তের একটি অংশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামে ব্যাপৃত হয়। অতঃপর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ নামে স্বাধীনতা লাভ করে।

উক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, বাঙালি জাতির প্রথম রাষ্ট্রব্যবস্থা (৭৫০-১১৬১ খ্রি.), দ্বিতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা (১৩৫২-১৫৭৬ খ্রি.) ও তৃতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা (১৯৭১- ) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে ও ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে, যেগুলোর প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন যথাক্রমে মহামতি গোপল, শাহ-ই-বাঙ্গালা সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমানে যেহেতু বাঙালিদের জন্য ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে একটি নাগরিক রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছে এবং বাঙালি সমসত্ত্ব জাতি হিসেবে সুগঠিত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে, সেজন্য এই জাতির জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণ করার মতো ঐতিহাসিক ও আদর্শিক ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে। কাজেই এখন বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক আদর্শের অনুসরণে চতুর্থ রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্মাণ করার উপযুক্ত সময়। কাজেই বাঙালি জাতির জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক রাজনৈতিক আদর্শ ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

লেখক: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আজকের দিনটি কেমন কাটতে পারে? জেনে নিন রাশিফলে

থানচিতে জরায়ু ক্যানসারের টিকা পাবে ১২৩৫ কিশোরী

কিউবায় তিন দিন পর বিদ্যুৎব্যবস্থা স্বাভাবিক

শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আশরাফুল মুনিম

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

২২ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

চাঁদপুরে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

অটোমেটেড মেশিনের দিকে ঝুঁকছে পোশাক কারখানার মালিকরা

১০

ব্যারিস্টার সুমন গ্রেপ্তার

১১

মধ্যরাতে ব্যারিস্টার সুমনের ভিডিও বার্তা

১২

ব্যারিস্টার সুমন কি গ্রেপ্তার হয়েছেন?

১৩

আইটেক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ভারতে গেলেন ১০ কর্মকর্তা

১৪

চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেপ্তার ৩

১৫

শুরু হলো আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ৭১ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প

১৬

বাবা হত্যার দায়ে ছেলের মৃত্যুদণ্ড

১৭

দৌলতদিয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আটক

১৮

বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে প্রাণ গেল কিশোরের

১৯

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বেরোবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

২০
X