মোস্তফা কামাল
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২৫ এএম
আপডেট : ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শেখ হাসিনাকে ফেরতের ক্যাচাল

শেখ হাসিনাকে ফেরতের ক্যাচাল

একাশিতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা শেখ হাসিনা ঘটনার অনিবার্যতায় চব্বিশে ভারতেই গেছেন। যেখান থেকে আসা, সেখানেই যাওয়া। বৃহস্পতিবার গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, পলাতক শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে যা যা করা দরকার, তাই করা হবে। শেখ হাসিনা দিল্লিতেই আছেন উল্লেখ করে বলেন, ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানায় থাকা বাকিদেরও অবস্থান শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ দিনটিতেই ছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিং। এতে মন্ত্রণালয়টির মুখপাত্র রনধীর জয়শওয়াল সোজাসিধা বলে দেন, শেখ হাসিনা ভারতে আছেন, ভারতেই থাকবেন।

এসব কথার তথ্য কাছাকাছি। তবে ব্যাখ্যায় হেরফের। যে যেভাবে বোঝে, বুঝে নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সেই দৃষ্টে যে যার মতো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেশে ফেরত আসা বা আনা নিয়ে গসিপ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ৫ আগস্ট তিনি প্রাণরক্ষায় ভারতে পালিয়েছেন নাকি নানাপক্ষের মধ্যস্থতায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে এক্সিট নিয়েছেন—সেই বাহাসেও মাত্রা যোগ হয়েছে। একদিকে বলা হচ্ছে, তাকে ধরে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর হুঙ্কার। অন্যদিকে, তাকে বিজয়ীর ভেসে গলায় মালা দিয়ে দেশে আনার শপথের কথা জানান দেওয়ার মহড়া। তা কিছুটা সোশ্যাল মিডিয়ায়। বাকিটা ফরিদপুর-গোপালগঞ্জে শোডাউনে।

জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি গত কদিনের মধ্যে একটি বড় ঘটনা। আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরেক অভিযোগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, পরোয়ানা জারি হওয়া ব্যক্তিদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে।

জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরুর প্রথম দিনটি বৃহস্পতিবার। বেলা সাড়ে ১১টায় গণহত্যার ঘটনায় করা মামলার বিচার করতে নিয়োগ পাওয়া তিন বিচারপতি ট্রাইব্যুনালে আসেন। এরপর চিফ প্রসিকিউটর ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অপরাধ, দুর্নীতি, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অপকর্ম তুলে ধরেন। একই সঙ্গে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলি করে গণহত্যার সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।

চিফ প্রসিকিউটর আরও জানান, আদালতে গণহত্যার অভিযোগ নিয়ে পরবর্তী শুনানি ১৮ নভেম্বর হলেও এর আগে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তখনই আদালতে হাজির করা হবে। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৬৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ ৪৫ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং কর্মকর্তাদের অবস্থান চিহ্নিত করা হবে বলে জানান তিনি। প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনাসহ যারা পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন; তাদের বিষয়ে আদালতের পরোয়ানা কীভাবে তামিল হবে? ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ৩৯ বছর পর যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল এবং তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়।

এ ট্রাইব্যুনালের রায় কার্যকর করে অনেককেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার’ আদর্শ থেকে সরে এসে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ পাস করে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকার কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অনির্দিষ্টকালের জন্য কাউকে আটক করতে পারে।

এই আইন পাস করে হাজার হাজার প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়। ৩৯ বছরের পুরোনো ঘটনা নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য পরিচালনার সময় সাক্ষ্য-প্রমাণের অপ্রতুলতার কারণে বিচারকার্য নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মাত্র দুই মাস পর বিচারকার্য পরিচালনার সময় তথ্য, উপাত্ত, আলামত, সাক্ষ্য-প্রমাণের কোনো অভাব হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের পর চরম সংকটে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেওয়ার পর তাকে ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ দিয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরটি বেশ চাউর। এই ট্রাভেল ডকুমেন্টে কি বন্দিবিনিময় চুক্তির মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরানো কঠিন হবে কি না—সেই প্রশ্নও উঠছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন দিন কয়েক আগে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট দেওয়া হলে তা ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা এখন যে দেশে আছেন সে দেশের সঙ্গে আমাদের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তারা শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে বাধ্য।’ তাহলে বাংলাদেশ কবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইবে সেটি নিয়েও আলোচনা হচ্ছিল দেশের রাজনীতিতে। আর ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাও শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার এক ধরনের উদ্যোগ। আবার ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনার যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, সেটিকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ফেরত চাওয়া খুব বেশি কাজে নাও আসতে পারে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা’য় অভিযুক্ত বা ফেরারি আসামি ও বন্দিদের একে-অন্যের কাছে হস্তান্তরের জন্য একটি চুক্তি আছে ২০১৩ সাল থেকেই। চুক্তি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির নামে মামলা বা অভিযোগ দায়ের হয় বা তিনি দোষী সাব্যস্ত হন অথবা দেশের আদালত থেকে প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ করার জন্য ফেরত চাওয়া হয়, তাহলে তাকে ফেরত দেবে বাংলাদেশ ও ভারত। প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ বলতে চুক্তিতে সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড হয় এমন অপরাধকে বলা হয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক অপরাধও রয়েছে। তবে কোনো অপরাধ প্রত্যর্পণযোগ্য হওয়ার জন্য দ্বৈত অপরাধের নীতি অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ অপরাধটি অবশ্যই দুদেশে শাস্তিযোগ্য হতে হবে। ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, কেউ কোনো অন্যায় করে আইনিভাবে দোষী সাব্যস্ত হলে ওই ব্যক্তিরা বাংলাদেশ বা ভারতে আশ্রয় নিলে উভয় দেশ চুক্তি অনুযায়ী তাকে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। আবার চুক্তিতে বলা হয়েছে, অপরাধটি ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ হলে যে কোনো দেশ প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। হত্যা, আক্রমণ, বিস্ফোরণের কারণ, জীবন বিপন্ন করার উদ্দেশ্যে বিস্ফোরক পদার্থ বা অস্ত্র তৈরি বা নিজের কাছে রাখাসহ বেশ কিছু অপরাধকে রাজনৈতিক বলার সুযোগ নেই।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি ২০১৩ সালে করা হলেও ২০১৬তে মূল চুক্তিটি সংশোধন করা হয়। সংশোধনের সময় এমন একটি ধারা যুক্ত করা হয়েছিল, যা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বেশ সহজ করে তুলেছিল। সংশোধিত চুক্তির ১০-এর (৩) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেসব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না করলেও চলবে; শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে। গত দুই মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুইশরও বেশি মামলা হয়েছে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে।

চুক্তি অনুযায়ী এ ধরনের অপরাধে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে পারে ভারত। এগুলো একদম আইনের কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই চুক্তি থাকলেও এখানে শেখ হাসিনার জন্য লাইফ থ্রেটের বিষয় থাকলে, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার শঙ্কা থাকলে তাকে ফেরত দেওয়ার আগে ভারত অবশ্যই সেটা ভাববে। চুক্তি অনুযায়ী, যদি আদালত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেনও, তাকে ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দরকার হতে পারে। মানে আইন ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সমন্বয় হলেই কেবল শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে পারে ভারত। এখনই সেই সুযোগ বা প্রেক্ষিত কি আছে? থাইল্যান্ডের সঙ্গেও বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। চুক্তির এমন থাকা, না থাকাও খুব ম্যাটার করে না, যা শেখ হাসিনা প্রশ্নে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রের মুখেও এসেছে। তার ‘শেখ হাসিনা ভারতে আছেন এবং থাকবেন’ বার্তার মধ্যে তা পরিষ্কার।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ওয়ার্ল্ড ভিশনে চাকরির সুযোগ

লক্ষ্মীপুরে স্ত্রীর জানাজায় অসুস্থ হয়ে জামায়াত নেতার মৃত্যু

আজকের দিনটি কেমন কাটতে পারে? জেনে নিন রাশিফলে

থানচিতে জরায়ু ক্যানসারের টিকা পাবে ১২৩৫ কিশোরী

কিউবায় তিন দিন পর বিদ্যুৎব্যবস্থা স্বাভাবিক

শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আশরাফুল মুনিম

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

২২ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

ঢাকার যেসব এলাকায় আজ মার্কেট বন্ধ

১০

চাঁদপুরে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রী হত্যার দায়ে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড

১১

অটোমেটেড মেশিনের দিকে ঝুঁকছে পোশাক কারখানার মালিকরা

১২

ব্যারিস্টার সুমন গ্রেপ্তার

১৩

মধ্যরাতে ব্যারিস্টার সুমনের ভিডিও বার্তা

১৪

ব্যারিস্টার সুমন কি গ্রেপ্তার হয়েছেন?

১৫

আইটেক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে ভারতে গেলেন ১০ কর্মকর্তা

১৬

চালককে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেপ্তার ৩

১৭

শুরু হলো আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের ৭১ কোটি টাকার পুনর্বাসন প্রকল্প

১৮

বাবা হত্যার দায়ে ছেলের মৃত্যুদণ্ড

১৯

দৌলতদিয়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আটক

২০
X