অত্যাচারী ফেরাউনও তার অনুসারীদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। হিটলার ও মুসোলিনিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তাদের শেষ পরিণতি ছিল মর্মান্তিক। নীল দরিয়ায় ডুবে মরেছিলেন পাষাণ ফেরাউন। মুসোলিনিকে গুলি করে হত্যার পর তার মরদেহ একটি রেলস্টেশনে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। হিটলারকে বেছে নিতে হয়েছিল আত্মহননের পথ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্টদের মৃত্যু হয়েছে নির্বাসিত জীবনে, অনেকটা রাষ্ট্রহীন বেওয়ারিশ নাগরিকের মতো
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর কেটে গেছে দুটি মাস। এই রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা কর্তৃক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন দেড় সহস্রাধিক মানুষ। রাজপথে এখনো রক্তের দাগ শুকায়নি। বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ। এখনো থামেনি সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। দুর্বিষহ যন্ত্রণায় এখনো আহতরা দিশেহারা। তাদের কষ্টে ভারী হয়ে আছে বাতাস। এমন দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যেই দূর থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে হায়েনার হাসি আর পিশাচের গর্জন। ফ্যাসিবাদীর অনুচররা আদিম সরীসৃপের মতো বুকে ভর দিয়ে আবার সক্রিয় হতে শুরু করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়াতে শুরু করেছে গুজব। এই গুজবের মাধ্যমে তারা হাসিনা আমলের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক ডাকাতি, হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, বিশ্বের উন্নত দেশে বেগমপাড়া তৈরি, আয়নাঘর তৈরির মাধ্যমে পৈশাচিক নির্যাতনসহ গুম, খুন ও অপহরণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধকে মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে দিতে চায়। পলাতক জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা সাধারণ মানুষের মন থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চায় আওয়ামী দুঃশাসনের সেই অভিশপ্ত পরিস্থিতি। এই মিশনে তারা এরই মধ্যে খানিকটা সফলও হয়েছে। মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে অনেকেই আওয়ামী লীগ আমলের অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে শুরু করেছেন। আর এর বিপরীতে সামনে আসতে শুরু করেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা, শুরু হয়েছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাবে। অনেকেই আশাহত হচ্ছেন, হতাশও হচ্ছেন কেউ কেউ। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির হিসাব তারা মেলাতে পারছেন না। তবে এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সরকারকে পথ চলতে হচ্ছে অন্তহীন সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে। রাত পোহালেই সকালটা সবসময় অরুণ আলোয় আলোকিত হয় না। পূর্বদিগন্তে এখনো ধূসর কালো মেঘের ঘনঘটা। ঝড় থামলেও মেঘ কাটেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে মাফিয়া রানি পালিয়ে গেলেও রাষ্ট্রের সব স্তরে রয়ে গেছে তার অনুসারীরা। শেখ হাসিনার প্রশাসনের মাধ্যমেই চলছে দেশ। রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে তা এখনো কমিশন গঠনের পর্যায়েই রয়ে গেছে। সংস্কারের উদ্যোগ এখনো কার্যকর হতে শুরু করেনি। আইন, আদালত, বিচারক কোনো কিছুই পাল্টায়নি, সাক্ষীরাও মিথ্যে সাক্ষী দিতে ভুলে যায়নি, ফলে প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় এখনো গতি ফেরানো যায়নি।
ফ্যাসিবাদী সরকারের অর্থনৈতিক দুরাচারের চেয়ে নৈতিক ক্ষতিটা আরও ভয়াবহ। অতীতে আমরা বহু লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীকে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখেছি। স্বৈরশাসকের নিপীড়নে তারা নষ্ট হননি, বশ্যতা স্বীকার করেননি, নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দেননি। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে দেখলাম তাদের অনেকেই ফ্যাসিস্ট হাসিনার কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন, নির্লজ্জ দালালে পরিণত হলেন। ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগ, সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি এবং রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের লোভে তারা নীতি-নৈতিকতা বর্জন করে, বিবেককে বন্ধক রেখে শেখ হাসিনার পা-চাটা কুকুরে পরিণত হলেন। হাসিনার পতনের পর তারা কয়েকদিনের জন্য গা-ঢাকা দিলেও এখন তারা আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় ফ্যাসিবাদ কত বেশি শক্তিশালী স্বৈরতন্ত্রের তুলনায়। স্বৈরতন্ত্র হলো এক ধরনের শৃঙ্খল। এ দিয়ে মানুষকে বাঁধা যায়, নির্যাতন ও নিপীড়ন করা যায়, কিন্তু মানুষের মন ভোলানো যায় না, তাকে বসে আনা যায় না, যায় না পোষ মানানো, পরিণত করা যায় না দাসে। তাই অতীতে বৈরী পরিস্থিতিতে যারা স্বৈরাচারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিলেন, স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর তাদের অনেকেই শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছেন। তারা স্বাধীন চিন্তা এবং মুক্তজীবনে ফিরে গেছেন। কিন্তু ফ্যাসিবাদ হলো অনেকটা আফিমের নেশার মতো। এটা মানুষকে অন্ধবিশ্বাসে আসক্ত করে। দুর্নীতি, দুঃশাসন, গুম, খুন এমনকি আয়নাঘর সৃষ্টির মতো মানবতাবিরোধী কাজকেও ফ্যাসিবাদ আদর্শায়িত করে। এসব পৈশাচিক অপরাধকে তারা মান্যতা দেয়, বৈধতা দেয়। এগুলোকে তারা কোনো অন্যায় বলে মনে করে না। ফলে ফ্যাসিবাদের পতন হলেও তার অনুসারীদের আমরা এসব মানবতাবিরোধী কাজের জন্য কোনো প্রকার অনুশোচনা বোধ করতে দেখি না। মাফিয়াতন্ত্রের মহারানি জনরোষে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরও তার অনুসারীদের আমরা তাকে আগের মতোই শ্রদ্ধা ভক্তি করতে দেখি। শেখ হাসিনা সর্বগ্রাসী দুর্নীতিবাজ এবং রক্তপিপাসু দানব হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি অনুসারীদের শ্রদ্ধাবোধ এতটুকু কমে না। ফ্যাসিবাদ আফিমের নেশার মতোই তার অনুসারীদের আচ্ছন্ন করে রাখে, তাদের এই নেশার ঘোর কখনো কাটতে চায় না। অত্যাচারী ফেরাউনও তার অনুসারীদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। হিটলার ও মুসোলিনিও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তবে তাদের শেষ পরিণতি ছিল মর্মান্তিক। নীল দরিয়ায় ডুবে মরেছিলেন পাষাণ ফেরাউন। মুসোলিনিকে গুলি করে হত্যার পর তার মরদেহ একটি রেলস্টেশনে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। হিটলারকে বেছে নিতে হয়েছিল আত্মহননের পথ। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্টদের মৃত্যু হয়েছে নির্বাসিত জীবনে, অনেকটা রাষ্ট্রহীন বেওয়ারিশ নাগরিকের মতো।
শেখ হাসিনার কোনো নীতি ছিল না, দুর্নীতি ভিন্ন। সৌভাগ্য আমাদের শেখ হাসিনার এই নৈতিকতাকে দেশের মানুষ গ্রহণ করেনি। তার বিরুদ্ধে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। এই বিক্ষুব্ধ হওয়ার অনেক কারণ ছিল। সর্বজনীন ও সর্বাধিক শক্তিশালী কারণ হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতারণা, প্রহসন এবং ভণ্ডামি। এসব কারণে সর্বস্তরের মানুষ তাকে হৃদয়ের গভীর থেকে ঘৃণা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সামনে রেখে তিনি এবং তার দলের লোকেরা দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এসব টাকা বিদেশে পাচার ও বিশ্বের উন্নত দেশে বেগমপাড়া তৈরি করেছে। সর্বোপরি গুম, খুন এবং আয়নাঘর তৈরির মাধ্যমে সারা দেশে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল, তা মানুষের হৃদয়ের গহিনে ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হয় এবং একসময় দাবানলের সৃষ্টি করে। একটি দেশের জাতীয় চেতনাকে ধারণ করে, সেই দেশের মানুষের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন, জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন এবং এসব সম্পদ বিদেশে পাচার আধুনিক বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। শেখ হাসিনা তার এসব অপকর্ম আদর্শায়িত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পিতা শেখ মুজিবকে সামনে রেখে। ফলে শেখ হাসিনার পতনের পর বিক্ষুব্ধ মানুষ ছুটে যায় শেখ মুজিবের ভাস্কর্যের দিকে, মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়ে ফ্যাসিবাদের দম্ভের প্রতীক গণভবন এবং শেখ মুজিবের মূর্তির ওপর। শেখ হাসিনার মধ্যে অবশ্যই এই বোধ ছিল যে, মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ একদিন আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাতের মতো বিস্ফোরিত হতে পারে। তাই তিনি নিজেকে রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের মাধ্যমে নিজের চারপাশে গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। কিন্তু বাংলায় একটা প্রবাদ আছে—‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। হয়েছেও তাই! লোকচক্ষুর অন্তরালে গোকুলে বেড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ বধের নায়করা। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা অগণিত তরুণ-তরুণী মৃত্যু ভয়কে উপেক্ষা করে মুখোমুখি হয় ফ্যাসিবাদের এক নৃশংস দানবের। আর তাদের পাশে বুকভরা আগুন নিয়ে এগিয়ে আসে অগণিত বীর জনতা। শুরু হয় হাসিনার দুর্ভেদ্য প্রাচীরের সঙ্গে ছাত্র-জনতার প্রাণের লড়াই। এ লড়াইয়ে প্রাণের কাছে পরাজিত হয় প্রাচীর। ফ্যাসিবাদের দম্ভের প্রাচীর তাসের ঘরের মতো ভেঙে খান খান হয়ে যায়। শেখ হাসিনার রক্তের পিপাসা মেটাতে ছাত্র-জনতা দলে দলে আসে। যেমনটা এসেছিল ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে, পলাশ-শিমুল ফোটা একুশের মধ্য দুপুরে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ডাকে ছাত্র-জনতা যেমনটা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিল ঊনসত্তরে জানুয়ারির শীতার্ত দিনগুলোতে। মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বুকে চেপে ছাত্র-জনতা যেভাবে বিক্ষুব্ধ হয়েছিল একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে। যেভাবে মানুষ ফুঁসে উঠেছিল নব্বইয়ের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী এরশাদের দুঃশাসন রুখে দিতে। তেমনিভাবে ওরা আবার ফিরে আসে, দলে দলে আসে, চব্বিশের বর্ষণমুখর দিনগুলোতে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে এক ভয়ানক শ্বাপদ হয়ে। ছাত্র-জনতা হাসিনার তখতে তাউস জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। অনুভূতিহীন এক পরাক্রমশালী দানব ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাই আমাদের ভয় নেই, অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে ওরা আবার আসবে। আরেক ফাল্গুনে ওরা আবার আসবে আগুন হয়ে। ফ্যাসিবাদের ঔদ্ধত্যকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। এ দেশের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে শহীদের রক্ত আর বীরাঙ্গনার অশ্রু। সেই শহীদের রক্ত এবং বীরাঙ্গনার অশ্রু নিয়ে যারা চেতনার ব্যবসা করেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, আয়নাঘর সৃষ্টির মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে, সেসব বেইমান, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারকদের ইতিহাস কোনো দিন ক্ষমা করবে না। তাদের ক্ষমা করার চারিত্রিক শক্তি ইতিহাসের নেই...
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক