দুই পুত্রের মাঝে কে শ্রেষ্ঠ? কে মাকে বেশি ভালোবাসেন? এটা প্রমাণে তৎক্ষণাৎ প্রিয় বাহন ময়ূর নিয়ে পুরো পৃথিবী চক্কর দিতে বেরিয়ে পড়লেন কার্তিক। স্থূলদেহের অধিকারী গণেশ পড়লেন বিপাকে। বিশাল বপু নিয়ে নড়াচড়াই কষ্টকর তার জন্য। তাই মাকে পৃথিবী জ্ঞান করে দেবী দুর্গাকে প্রদক্ষিণ করলেন তিনি। কোনো সন্তানের ভক্তিকেই ছোট মনে করলেন না মাতৃদেবী।
ভক্তের সাধ্যমতো প্রার্থনাই দশভুজার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। দশজনার আন্তরিক আরাধনাকে আরাধ্য় মনে করেন দেবতারা। সামাজিক প্রয়োজনে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হতে পারে। কিন্তু দেবীর কৃপা লাভে পূজারির সরলতাই যথেষ্ট। আড়ষ্টতা ছুড়ে ফেলে ভক্তি গদগদ চিত্তে পাদপদ্মে হৃদয়াঞ্জলি সমর্পণই কাঙ্ক্ষিত। যুগ যুগ ধরে শান্তির বার্তা নিয়ে কৈলাস থেকে ধরাধামে আসেন দুর্গতিনাশিনী। তবে প্রতিবারই নতুন নতুন গোঁয়ার মহিষ নিয়ে শ্য়ামল বাংলায় আবির্ভূত হয় অসুর। এতে ভক্তদের দুর্গতির আর শেষ থাকে না। এবারও স্নিগ্ধ শরতে আগে থেকেই বৃষ্টির মতো গুজব ছড়িয়েছে অসুরের ছেলেমেয়েরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে গলদঘর্ম হয়েছে সরকার বাহাদুর। সেনাপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন বাহিনী প্রধান ময়দানে নেমে পূজারিদের সাহস ও দুর্বৃত্তদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। কামাল কামাল বলে মাঠে নেমেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের নেতা ও দামাল ছেলেরা। কিন্তু তাতেও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি। মানসিক প্রতিবন্ধী, রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানী, ভাড়াটে দুষ্কৃতকারী ঢুকে পড়েছে মণ্ডপে। এমনকি সনাতন ধর্মাবলম্বী ব্য়ক্তিদের বিরুদ্ধেও দুর্বৃত্তপনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দেশের কয়েকটি জায়গায় মন্দির-মণ্ডপে প্রতিমা ভাঙচুর ও পূজারিদের ওপর হামলা হয়েছে। সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করেছে সরকার। মোটের ওপর উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে দেবী ফিরে গেছেন কৈলাসে। তবে এবারের দুর্গোৎসব ঘিরে দেশে অভিনব সব ঘটনা ঘটেছে।
আবহমান কাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে পরিচিত ও প্রচারিত হয়ে আসছে বাংলাদেশ। এর মধ্য়ে নীরবে নিভৃতে সংখ্য়ালঘু নির্যাতনের চোরাস্রোতও প্রবাহিত। রাজনৈতিক কারণে মাঝেমধ্যে সরব হয়ে ওঠে তা। প্রতিবেশী ভারতে সংখ্য়াগুরু হিন্দুর কর্মকাণ্ডের প্রভাব অনেক সময় বাংলাদেশের সংখ্য়ালঘুদের ঝুঁকিতে ফেলে। তা ছাড়া প্রেম-বিয়ে, বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ব্য়ক্তিগত ঘটনাও জাতীয় পর্যায়ে ঘনঘটার সৃষ্টি করে। এগুলো বহুল চর্চিত বিষয়। তবে শারদীয় দুর্গোৎসবকে নির্বিঘ্ন উৎসবমুখর রাখতে সচেষ্ট থাকে সবাই। সরকার থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল সব সংগঠন সতর্ক অবস্থান নেয়। কিন্তু এবারের তৎপরতা ছিল চোখে লাগার মতো। ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়াপড়শির ঘুম নাই’ প্রবাদের মতো। নিরাপত্তা নিশ্চিতে দলে দলে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা পূজামণ্ডপে অবস্থান নিয়েছে। বেশিরভাগ সময় তাদের দখলেই থেকেছে বক্তৃতা মঞ্চ ও অনুষ্ঠানমালা। এসব নেতার মধ্য়ে অনেকের আসুরিক শক্তির বদনামও আছে। তাদের কাউকে কাউকে বছরজুড়ে ভয় পেয়ে আসছে সাধারণ মানুষ। তারাই নিজে থেকে পূজারিদের ভয় তাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। এতে করে পূজার প্রাত্য়হিক আচারিক কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। সহযোগিতার চাপে অনেক জায়গায় ভক্তরা কোনোরকম ঠাকুর দর্শন করে কেটে পড়েছে। দলের নেতাকর্মীদের পাশে থাকার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্য়ান তারেক রহমান। ১০ অক্টোবর বিকেলে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। ধর্ম-বর্ণ, কিংবা ভৌগোলিক-আদর্শিক অবস্থান নির্বিশেষে, প্রত্যেক নাগরিক যেন তার ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অধিকার বিনা বাধায় উপভোগ করতে পারে—এ লক্ষ্যেই মুক্তিযোদ্ধারা লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিষ্টান এমন প্রশ্ন ছিল না।’
তিনি লেখেন, ‘তাই স্বাধীন বাংলাদেশেও তথাকথিত সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নিয়ে চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। দেশের প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে, এটিই বিএনপির নীতি এবং রাজনীতি। আমরা বিশ্বাস করি দলমত, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার এবং নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার।’
তার এ মন্তব্য়ের মাধ্য়মে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে দেশবাসী নতুন স্লোগান পেল। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ জনপ্রিয় এ স্লোগানটি আওয়ামী লীগ সমর্থকরা এতদিন দেদার ব্য়বহার করেছে। ধর্মীয় উৎসব সবার বলার ক্ষেত্রে বিএনপিপন্থিদের অস্বস্তি ছিল। ফলে সমমানের একটি স্লোগানের অভাব অনুভব করছিল তারা। এবারের পূজায় তারেক রহমান সে অভাব ঘুচিয়ে দিয়েছেন। ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ স্লোগানটি এখন জাতীয়তাবাদীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্য়মে শোভা পাচ্ছে। রাষ্ট্র সংস্কারের এ সময় স্লোগানটি জুতসই মনে করছে অনেকে। এদিকে, জামায়াতও পিছিয়ে নেই। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এরই মধ্য়ে সবদিক দিয়ে এগিয়ে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে পূজামণ্ডপে তাদের অনুসারীদের ইসলামী গান পরিবেশন অতি উৎসাহ হিসেবে ব্য়াপক সমালোচিত হয়েছে। যদিও এর পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাহাস হয়ে গেছে। জামায়াত অবশ্য় মণ্ডপশিল্পীদের অস্বীকার করেছে।
জামায়াতের সবদিক দিয়ে এগিয়ে থাকার উদ্য়োগ তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্য়মে দৃশ্য়মান হচ্ছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান, কূটনৈতিকপাড়ায় দৌড়ঝাঁপ, রাষ্ট্রের মৌলিক বিষয়ের সংস্কার প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য় তৎপরতা। তবে ধর্মাশ্রয়ী এই দলটির উদার রাজনীতি চর্চায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশের জন্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্য়ের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের স্ববিরোধিতা আছে। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইলে তাদের পুনর্মূল্য়ায়নের প্রশ্ন আসে। সম্প্রতি সংবিধান নিয়ে আগ বাড়িয়ে কথা বলে সমালোচনার মুখে পড়েছে তারা। জামায়াত আমিরের বক্তব্য়ের প্রতিবাদে বিবৃতি ছাপা হয়েছে কাগজে। এতে বলা হয়, ১০ অক্টোবর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবিধান নিয়ে জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের বক্তব্য ছাপা হয়। সেখানে জামায়াতের আমির বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সংবিধান ভারতের মাটিতে বসে রচনা করা হয়েছিল। তাই আমাদের সংবিধান জন্মভূমি হিসেবে বাংলাদেশকে পায়নি।’ জামায়াতের আমিরের ওই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয় খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের পরিবারগুলোর বিবৃতিতে। এতে বলা হয়েছে, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতেই সংবিধান রচিত হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ দর্শনকে ধারণ করে লাখো শহীদের রক্তে লিখিত বাংলাদেশের সংবিধান। এটি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনা ও তর্কবিতর্কের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে সংবিধান বিল গণপরিষদে পাস হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে সংবিধান কার্যকর হয়।’ এই বিবৃতির পর জামায়াত অবশ্য এ ব্যাপারে আর কিছু বলেনি।
সম্প্রতি ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষ পরিবর্তনের আশায় স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এই স্বপ্ন পুরো জাতিকে ভয়াবহভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তারা মনে করে ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেছে। রাস্তায় যানজট নেই। কেউ ঘুষ খাচ্ছে না, দুর্নীতি করছে না। সরকারি কর্মকর্তারা জনসেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড শত্রুতায় মুখোমুখি রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে ঠেলছে ক্ষমতা নিতে। তারা বলছে, জনসেবা করতে ক্ষমতা লাগে না। এসব হয়তো সত্যি হতো। যদি মানুষগুলো বদলে যেত। হাস্যকর ব্যাপার হলো, কেউ বদলায়নি। শুধু অন্যরা কেন বদলায় না, তাই নিয়ে আহাজারি করছে। আর হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরছে। হঠাৎ স্বাধীনতা পেয়ে যে যেভাবে পারছে সেজেগুজে ঘুরছে। এমনকি, দেড় সহস্রাধিক সহযোদ্ধার রক্তে স্নাত হয়ে ক্ষমতাগ্রহণকারীরাও যেন একই বৃত্তে ঘুরছে। দশ হাতে কাজ করার সময় তারা অজুহাত খুঁজছে। রাষ্ট্রীয় গজব থেকে রেহাই পেলেও গুজবমুক্ত হতে পারছে না জাতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ ইভেন্টের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে অংশীজনরা। নিজ নিজ মৌলিক কাজ বাদ দিয়ে বিভিন্ন ইভেন্টে হামলে পড়ছে দায়িত্বশীলরা। এতে করে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির বদলে আস্থাহীনতার সংকট বাড়ছে। এ বাস্তবতা শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের নয়, পরবর্তী সরকার গঠনে প্রত্যাশীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। আসলে কাজের কোনো বিকল্প নেই। হোক সে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তিগত। সুন্দর সুন্দর কথা বেশি দিন ভালো লাগে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথা নিষ্ঠুরভাবে প্রমাণিত।
লেখক: যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক কালবেলা