কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০৩ এএম
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৩৬ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণমানুষের মালিকানা চাইলে রিসেট দিতেই হবে

গণমানুষের মালিকানা চাইলে রিসেট দিতেই হবে

সাম্প্রতিক কালে সবার মধ্যে রিসেট শব্দটির এক ধরনের মধুর অনুরণন তৈরি হয়েছে। এই অনুরণন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ব্যবহৃত রিসেট শব্দটির পরিপ্রেক্ষিতে। ৯ তারিখ সন্ধ্যায় ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের এক সাংবাদিকের একটা ফোন এলো। তার অনুরোধ, রিসেট নিয়ে আমাকে একটা বক্তব্য দিতেই হবে। সে পরিপ্রেক্ষিতেই আসলে রিসেট নিয়ে আমার ভাবনা। সাক্ষাৎকার দিলাম। আবার বিস্তারিত লিখে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম ‘সাম্প্রতিক রিসেট প্রসঙ্গ ও আমার নতুন বয়ান’ শিরোনামে। ১০ তারিখ দেখলাম, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে রিসেটের বিষয়ে একটি বিবৃতি। রিসেটের বিষয়ে আমার ৯ তারিখের উপস্থাপিত বয়ানের সঙ্গে ১০ তারিখের বিবৃতির কাকতালীয় কিছু মিলও পেলাম। সেদিনই একই বিষয়ে যমুনা টিভি এবং এখন টিভিতে সাক্ষাৎকারে রিসেটের বিষয়টি আরও বিস্তৃত করার সুযোগ পেলাম। তার পরও মনে হচ্ছে, এ বিষয়ে আরও কিছু লেখার প্রয়োজনীয়তা আছে।

আমরা সবসময়ই হুজুগ নিয়ে পড়ে থাকি—এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। একদল অনুরণন পাচ্ছে, উনার রিসেট শব্দটির ব্যবহার কতটা বাংলাদেশের মৌলিক ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য, সেই বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বা গর্বের বিষয়গুলো রিসেট দিতে কেন বলবে? ইতিবাচক ধারার অর্জনগুলো রিসেট দিলে তো আমি থাকি না। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তো ’৭১-এ গঠিত বাংলাদেশেই তৈরি হয়েছে। ’৭১-এর ভিত্তিতেই তো এই সরকার। আমি যতদূর বুঝেছি, তিনি তার সাক্ষাৎকারে একবারও বলেননি ইতিবাচক মৌলিক অর্জনগুলোকে রিসেট দিতে। প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তিনি চব্বিশের বিপ্লব, বিপ্লবে প্রাণহানি এবং সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের যে প্রত্যয় ছিল, সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশ্নের এক নতুন উত্তর নির্মাণ করেছেন। এটা ব্যতিক্রম। এটা তার দক্ষতা। শিক্ষিত শাসক হওয়ায়, প্রশ্নকর্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লবকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণকে সামনে এনেছেন। এটাই তো উনার কাজ। এ জন্যই উনাকে ২৪-এর বিপ্লব-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের কৃতিত্ব হলো বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে রিসেট শব্দটিকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে সামনে নিয়ে আসা। তিনি তাই করছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। রাজনীতিতে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নিতে হয়। সে অবস্থানই রাজনীতির নতুন পথ তৈরি করে, দেয় নতুন মাত্রা। সে কারণে প্রধান উপদেষ্টার হাত ধরে রিসেট শব্দটি বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের পরিপ্রেক্ষিতে নতুনভাবে এসেছে। এটা প্রয়োজন ছিল। তাই হয়েছে। তিনি রিসেট শব্দটি আলোচনায় এনেছেন, কিন্তু আমরা সেই রিসেটটা নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে কীভাবে করব, সেটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।

’৭১ সালকে মুছে ফেলার বিষয়টি আলোচনাতেই আসতে পারে না। ’৭১ গর্বের জায়গা, অহংকারের জায়গা। অর্জন। কিন্তু এই ’৭১-এর অশুভ ও বিকৃত রাজনৈতিক ব্যবহারকে আপনি কি আবার ধারণ করতে চান? নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে ’৭১-এর বিকৃত রাজনৈতিক ব্যবহার যেন আর কেউ না করতে পারে, সে বিষয়ে যথার্থ সংস্কারের মাধ্যমে রিসেট তো আপনাকে দিতেই হবে। অন্যথায় এই মহান অর্জনের বিকৃত ব্যবহার আবার ফিরে আসবে। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় আরোহণের ভিন্নতার কারণে ’৭১-এর গল্প আপনি ভিন্নভাবে শোনেননি? এই গল্পে গণমানুষের ত্যাগ অন্য আলোচনার তুলনায় কতটা প্রাধান্য পেয়েছিল? সেই প্রশ্ন আপনি করেন না? আপনি কি চান, পুরোনো বা নতুন ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচার আবার নিজেকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ’৭১-কে ব্যবহার করুক। নেতৃত্ব অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কিন্তু ’৭১-এ গণমানুষের স্বীকৃতি সবার আগে। আজকে ১১ অক্টোবর প্রথম আলোয় শ্রদ্ধেয় লেখক মহিউদ্দিন আহমদ যে জায়গা থেকে ’৭১-এর আলোচনা তুলে এনেছেন, সেই জায়গা থেকেই রিসেট প্রসঙ্গে তিন দিন ধরে বলে এসেছি—৭১, ৯০ ও ২৪-এর গণমানুষকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কী রিসেট দিতে হবে সেই প্রসঙ্গে বলেছি, মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাসকেও, বাংলাদেশকে ভালোবাসলে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ চাইলে, গণমানুষের মালিকানা চাইলে, মুক্তিযুদ্ধের সব বিকৃত ইতিহাস চিহ্নিত করে রিসেট দিতেই হবে। মহিউদ্দিন আহমদকে আমি ফেসবুকে ফলো করি। যে কোনো বিকৃত ইতিহাসকে রিসেট দেওয়ার চ্যালেঞ্জ আমি দিয়েছি। এ কথাগুলো যমুনা টিভি, ইনডিপেনডেন্ট টিভি এবং এখন টিভিতে তিন দিন ধরে বলছি। যাক মহিউদ্দিন আমারই বয়ান এগিয়ে নিলেন বা আমি তার বয়ান এগিয়ে নিলাম।

’৯০-এ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু গণমানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে নব্বই সফল হতো না। চব্বিশে অখ্যাত সাধারণ ছাত্র-জনতার রক্তের ফল। ইতিহাসে সাধারণ মানুষের স্বীকৃতি নিশ্চিত করেন। এর জন্য ইতিহাসেরও সংস্কার প্রয়োজন। এমনভাবে রিসেট দেন, যেন ৭১, ৯০, ২৪-এ এদেশের সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়ে মহান অর্জন—এই বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এখানে নেতারা নয়, কষ্ট করেছে, ত্যাগ করেছে, কৃষক, তাঁতি, মজুর, মেহনতি মানুষ। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, তরুণ, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসার ছাত্র। ইমাম, মুয়াজ্জিন ও পুরোহিত। আমরা সবাই। আপামর জনতার অংশগ্রহণের আগে তো ২৪-কে ঠুনকো আন্দোলন মনে হচ্ছিল। যখন সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্মের নাগরিক যুক্ত হলো এবং সব বয়সের মানুষ যুক্ত হলো তখনই তা পূর্ণতা পেল এবং আন্দোলন সফল হলো। আমরা যারা ১৫ জুলাইয়ের পরে বৈষম্যবিরোধী প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে ছিলাম, আমরা ঝুঁকি নিয়েছি সাধারণ মানুষ হিসেবে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতেই। বাংলাদেশের ট্র্যাজেডি হলো সঠিক ব্যক্তি সঠিক জায়গায় স্থান পায় না। শুধু তাই নয়, এখানে যে ব্যক্তি জীবন-জীবিকার ঝুঁকি নেয়, ত্যাগ করে, সেও স্বীকৃতি পায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংকটে ঝুঁকি নেওয়া সত্যিকারের যোদ্ধাদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করার জন্য রিসেট তো দিতেই হবে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বৈরাচার আছে, ফ্যাসিবাদ আছে, দুর্নীতি আছে, অপশক্তি আছে, ব্যাপক অন্যায় আছে। আপনি স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের উৎখাত করতে রিসেট বাটন চাপবেন না? অধ্যাপক ইউনূস গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে রিসেট বাটনের কথা বলেছেন এবং এই রিসেট কীভাবে হবে, সেটাও বলেছেন। সংস্কারের কথা বলেছেন। গণঅভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সংস্কারের কথা বলেছেন। এই সংস্কার হলো রিসেট বাটনের এজেন্ট। বাংলাদেশের মানুষের সব ইতিবাচক ইতিহাস-ঐতিহ্যে রিসেট দিতে তো কেউ বলেনি। একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশের ইতিহাসে গণমানুষকে জায়গা দিন—এটাই রিসেট। সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে এবং এই সংস্কার বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যে যেসব মিথ্যা বয়ান আছে, সেখানেও লাগবে।

টেকসই নির্বাচন ও টেকসই রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা গঠন করে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই গণঅভ্যুত্থান পরিপ্রেক্ষিতে রিসেট। সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিরা ২৪-এর আত্মত্যাগ মাথায় রেখে, তরুণদের প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশকে ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাবেন—এভাবে রিসেট বাটন চাপাই দরকার। এই রিসেট আপনার অজান্তেই শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোসহ ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধীরা, ২৪-এর তরুণরা এবং অধ্যাপক ইউনূস কিছু কিছু সফটওয়্যার রিসেট করেছেন বিধায় ১৫ বছর পর আপনি, আমি উনার কথার এত তীব্র সমালোচনা করতে পারছি। সাম্প্রতিক কালে আলোচনায় আসা একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তার প্রসঙ্গে বলছি। প্রশাসনের একটা রুলস অব বিজনেস এবং কোড অব কন্ডাক্ট আছে, সেটা মেনে চলবেন অঙ্গীকার করেই তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেছেন। আমি সেটা মানতে পারব না বলেই দুটি বিসিএসে চাকরির সুযোগ সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম অনার্স ও মাস্টার্স দুটিতেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। এখন আমার মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক ভদ্রলোক শুধু মিডিয়া কাভারেজ পেতে চান! যাই হোক, সব মিলিয়ে নতুন রাষ্ট্র নির্মাণের প্রত্যয়ে রিসেট দিতেই হবে। এই রিসেট স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরির রিসেট। যে রিসেটে বাংলাদেশের গণমানুষের স্বীকৃতি থাকবে এবং সব কাজে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। রাষ্ট্রের শাসকরা নাগরিকদের কাছে কার্যকরভাবে জবাবদিহি করবেন তাদের কর্মের জন্য।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুই লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন বহু যাত্রী

চাল ধোয়া পানিতে লুকিয়ে আছে স্কিনের আসল রহস্য

দুই নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান

দেশ কোনো দলের কাছে ইজারা দেওয়া হয়নি : ধর্ম উপদেষ্টা

কসবায় উদ্ধার করা মর্টারশেলের বিস্ফোরণ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কয়েকটি যানবাহনের সংঘর্ষ, নিহত ১

ঘন কুয়াশায় দুই নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

কোন কোন বিভাগে বৃষ্টি হবে জানাল আবহাওয়া অফিস

যৌথ বাহিনীর অভিযানে নারী মাদককারবারি গ্রেপ্তার

১০

শীতে অসুস্থ হতে না চাইলে খেতে পারেন এই সুপারফুডগুলো

১১

কম্পিউটার মনিটরে ওয়ারেন্টি সুবিধা বাড়াল ওয়ালটন

১২

সকালে হালকা গরম পানি খেয়ে বিপদ ডেকে আনছেন না তো?

১৩

নরসিংদীতে ছাত্রদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা

১৪

ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয় কল্পনাকে : পুলিশ

১৫

বায়ুদূষণে শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

১৬

আহ্ছানিয়া মিশনে চাকরির সুযোগ

১৭

পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ৯ ডিগ্রির ঘরে

১৮

দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে জাসাস : মীর হেলাল

১৯

টিভিতে আজকের খেলা

২০
X