ডা. প্রমিত অনন্য চক্রবর্তী
প্রকাশ : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:২২ এএম
আপডেট : ১২ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দুর্গাপূজায় সামুদয়িক আরাধনা

দুর্গাপূজায় সামুদয়িক আরাধনা

দুর্গাপূজার মূল ভিত্তি পুরাণ। স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন তার ‘দুর্গোৎসব’ ও ‘দুর্গাপূজাতত্ত্ব’ গ্রন্থে বিভিন্ন পুরাণ থেকে প্রমাণ ও বিধি চয়ন করেন। অকাল বোধনের বিধিটি ‘কালিকা পুরাণ’ থেকে নেওয়া। বোধনের সায়ংকালে তাই উচ্চারিত হয় এই মন্ত্র—

“রামস্য অনুগ্রহার্থায় রাবণস্য বধায় চ।

রাত্রাবেবমহাদেব ব্রহ্মণা বোধিতা পুরা।।”

নবপত্রিকা স্থাপনের বিধানটি ভবিষ্য পুরাণের। দেবী পুরাণ থেকে এসেছে কুমারী পূজার বিধিবিধান। অন্যদিকে দুর্গাপূজায় পশুবলির বিধান এসেছে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, কালিকা পুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে।

সপ্তমী থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত দেবীর মাহাত্ম্যকথা পাঠের বিধান এসেছে মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে।

‘দুর্গা’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায়, কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে।

কুমারীর ধ্যান মন্ত্রটি ‘রুদ্রযামল’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে—

“বালরূপাঞ্চ ত্রৈলোক্যসুন্দরীং বরবর্ণিনীম।

নানালঙ্কার নম্রাঙ্গী ভদ্রবিদ্যা প্রকাশিনীম।।

চারুহাস্যাং মহানন্দ হৃদয়াং শুভদং শুভম।

ধ্যায়েৎ কুমারী জননীং পরমানন্দ রূপিণীম।।

দুর্গা শব্দটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কৃষ্ণযজুর্বেদের ‘তৈত্তিরীয় আরণ্যকের’ অন্তর্ভুক্ত ‘যাজ্ঞিকা উপনিষদে’। দেবীপুরাণ ও দেবী ভাগবতে দুর্গা দেবীকে নগরপালিকা ও দুর্গ রক্ষিণী হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে।

পণ্ডিতরা ‘দুর্গা’ শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে—দ=দৈত্যনাশিনী, উ-বিঘ্ননাশিনী, র-রোগনাশিনী, গ-পাপনাশিনী এবং আ-ভয় ও শত্রুনাশিনী।

দুর্গাপূজার মন্ত্র ও উপাসনা পদ্ধতিতে বৈদিক, পৌরাণিক ও তান্ত্রিক সমন্বয় লক্ষ করা যায়। ঘটস্থাপন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস, হোম, স্বস্তিবাচন, শান্তি মন্ত্র বৈদিক উৎসজাত। আবার দেবীদুর্গার ষোড়শ উপাচারে পূজা, নৈবেদ্য, নিবেদন প্রভৃতির মন্ত্র পৌরাণিক। দেবীর বীজমন্ত্র ন্যাস (মাতৃকান্যাস, অন্তরমাতৃকান্যাস, বাহ্যমাতৃকান্যাস, সঙ্ঘার মাতৃকান্যাস, অঙ্গন্যাস, বরণন্যাস, বীজন্যাস, করন্যাস) ইত্যাদি মন্ত্র তান্ত্রিক।

বৈদিক মন্ত্র সাত্ত্বিক, পৌরাণিক মন্ত্র রাজসিক এবং তান্ত্রিক মন্ত্র তামসিক গুণনির্ভর।

ভবিষ্য পুরাণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র তথা সকল শ্রেণির মানুষ এমন কি ম্লেচ্ছ, দস্যু সবাইকে দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণের সুযোগ অর্পণ করেছেন।

“ব্রাহ্মণৈঃ, ক্ষত্রিয়বৈশ্যঃ শূদ্রৈরন্যেশ সেবকৈঃ।

এবং নানাম্লেচ্ছগনৈঃ পূজ্যতে সর্বদস্যুভিঃ।।”

কালিকা পুরাণে বর্ণিত আছে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উপস্থিতিতে পূজা অনুষ্ঠান ও বিসর্জনের কথা।

দুর্গাপূজায় সংস্কৃতি চর্চা অন্তর্নিহিত। সপ্তমীতে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান কালে রাগ ও বাদ্য বাজানোর শাস্ত্রীয় নির্দেশনা রয়েছে। আটটি কলসের জন্য আটটি ভিন্ন ভিন্ন বাদ্য ও রাগের উল্লেখ রয়েছে।

(ক) গঙ্গাজল্পূরণ কলসের জন্য—মালব রাগ ও বিজয় বাদ্য, (খ) বৃষ্টি জল—ললিত রাগ ও দুন্দুভি বাদ্য (গ) সরস্বতী জল-বিভাষ রাগ ও দুন্ধুভি বাদ্য (ঘ) সাগরের জল—ভইরব রাগ ও ভীম বাদ্য (ঙ) পদ্মরাজ মিশ্রিত জল—কেদার রাগ ও ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য (চ) নির্ঝর জল—বরাড়ী রাগ ও শঙ্খ বাদ্য (ছ) সর্বতীর্থ জল—বসন্ত রাগ ও পঞ্চশব্দ বাদ্য ( জ) শুদ্ধজল পূরণ কলসে—ধানসী রাগ ও বিজয় বাদ্য।

মহামিলনোৎসব দুর্গাপূজায় সমাজের কারা কারা জড়িত?

(১) কর্মকার বা কামার—পেশা লৌহশিল্প; (২) কুমোর—পেশা মৃৎশিল্প (৩) কায়স্থ—হিসাব রক্ষণ (৪) গন্ধবণিক—পেশা ষোড়শ উপাচার, দশ মৃত্তিকা, গন্ধ চন্দন, মসলা (৫) গোয়ালা—পঞ্চগব্য ও দুগ্ধজাত দ্রব্য (৬) চণ্ডাল—পদ্মফুল ও পানিফল (৭) জেলে—মাছের জোগান (৮) ডোম—বাঁশেরসামগ্রী জোগান (৯) তেলি—ঘানির তেল (১০) তাম্বুলি—পানের জোগান (১১) ধোপা—বস্ত্র ধৌতকরণ (১২) নাপিত—ক্ষৌরকর্ম (১৩) পটুয়া—চিত্রকর্ম (১৪) মাহিষ্য-মালা ঝোলানো, কলাগাছ রোপণ (১৫) চরমকার—ঢাক ও বাজনা (১৬) ময়রা—মিষ্টান্ন জোগান (১৭) মালাকার—মালা, শোলার কাজ (১৮) শাঁখারী—শঙ্খ (১৯) তাঁতী—ধুতি, কাপড়, গামছা (২০) সদগোপ—শস্য ও কৃষিজ দ্রব্য (২১) সুবর্ণ বণিক—নবরত্ন (২২) সূত্রধর—প্রতিমা নির্মাণ (২৩) হাঁড়ি—চাটাই সরবরাহ (২৪) ব্রাহ্মণ—পৌরহিত্য (২৫) বৈদ্য—আয়ুর্বেদ দ্রব্য সরবরাহ।

তালিকাটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের কার্যকর অংশগ্রহণের ব্যবস্থা রেখেই পূজার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে তাই—কারা কারা জড়িত নয়? কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে এ কথাটাই প্রতিভাত হবে।

নবপত্রিকায় নয় ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ফসলকে পূজামণ্ডপে ঠাঁই দিয়ে জনজীবনে এর গুরুত্বকে সবার সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আশ্বিন মাসে পুজো হয়। এরপর যেন না ভিড়ে মরা কার্তিক। তাহলে খাদ্যাভাবে দেশ পর্যুদস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এই ব্যাপারে সতর্ক প্রস্তুতিও এই পূজার অন্যতম লক্ষ্য। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বৃহদায়তন ক্যানভাসে সর্বস্তরের গণমানুষের খাদ্য, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক সুরক্ষা বলয় প্রস্তুতকরণে উদ্বুদ্ধকরণ ও সম্মিলিত পরিচালনের উদ্দেশ্যেই এ পূজা। ঐক্য , সহনশীলতা, স্বার্থ ত্যাগ ও গণনেতৃত্ব চর্চার এ এক উদার ক্ষেত্র।

ওঁ তৎ সৎ।

লেখক: রোগতত্ত্ববিদ, ভ্যানকুবার, কানাডা

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অ্যাম্বুলেন্স-অটোরিকশার সংঘর্ষে প্রাণ গেল কৃষি কর্মকর্তার

দুই লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন বহু যাত্রী

চাল ধোয়া পানিতে লুকিয়ে আছে স্কিনের আসল রহস্য

দুই নৌরুটে ফেরি চলাচল শুরু

ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান

দেশ কোনো দলের কাছে ইজারা দেওয়া হয়নি : ধর্ম উপদেষ্টা

কসবায় উদ্ধার করা মর্টারশেলের বিস্ফোরণ

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কয়েকটি যানবাহনের সংঘর্ষ, নিহত ১

ঘন কুয়াশায় দুই নৌরুটে ফেরি চলাচল বন্ধ

কোন কোন বিভাগে বৃষ্টি হবে জানাল আবহাওয়া অফিস

১০

যৌথ বাহিনীর অভিযানে নারী মাদককারবারি গ্রেপ্তার

১১

শীতে অসুস্থ হতে না চাইলে খেতে পারেন এই সুপারফুডগুলো

১২

কম্পিউটার মনিটরে ওয়ারেন্টি সুবিধা বাড়াল ওয়ালটন

১৩

সকালে হালকা গরম পানি খেয়ে বিপদ ডেকে আনছেন না তো?

১৪

নরসিংদীতে ছাত্রদল কর্মীকে গুলি করে হত্যা

১৫

ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয় কল্পনাকে : পুলিশ

১৬

বায়ুদূষণে শীর্ষে দিল্লি, ঢাকার বাতাস ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’

১৭

আহ্ছানিয়া মিশনে চাকরির সুযোগ

১৮

পঞ্চগড়ে তাপমাত্রা নামল ৯ ডিগ্রির ঘরে

১৯

দেশীয় সংস্কৃতি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে জাসাস : মীর হেলাল

২০
X