বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি। একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠী প্রতি বছর নতুন করে বেকারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ফলে বেকারের সংখ্যা না কমে বরং ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান এ বেকারদের কর্মে নিয়োজিত না করতে পারলে বাংলাদেশ মূল্যবান শ্রমশক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
নতুন পদ সৃষ্টি বা পদসংখ্যা বৃদ্ধি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই বিদ্যমান শূন্যপদ পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বেকারত্ব পরিস্থিতির উন্নয়ন অনেকাংশে সম্ভব। আর এ ক্ষেত্রে নিয়োগ ব্যবস্থার সংস্কার অতি জরুরি।
স্বতন্ত্র নিয়োগ বোর্ড: একজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সদ্যস্য সহযোগে যথাযথ নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র নিয়োগ বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। বোর্ডের কাজ হবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। এ ক্ষেত্রে, বোর্ড নিয়োগ প্রক্রিয়ার সব কার্যক্রম সম্পন্ন করবে এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদামতো লোকবল নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদান করবে। নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ, গতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত করতে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষা কমিটি/প্যানেল গঠন করা যেতে পারে।
কেন্দ্রীয় অনলাইন ডাটাবেজ: নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক তৈরিকৃত একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন ডাটাবেজ থাকবে, যেখানে চাকরিপ্রত্যাশীরা তাদের সব শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের প্রমাণপত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট করবেন। তাদের প্রদেয় তথ্যের সপক্ষে প্রয়োজনীয় সফট কপিও সংযুক্ত থাকবে। প্রত্যেক চাকরিপ্রত্যাশীর জন্য স্বতন্ত্র ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড থাকবে, যার মাধ্যমে আবেদনকারী প্রয়োজনবোধে তথ্যসমূহ পরিমার্জন, সংশোধন ও সংযোজন করতে পারবেন।
নিয়োগ পরীক্ষার ধরন ও সময়সূচি: নিয়োগ বোর্ড শূন্যপদের নাম ও সংখ্যা উল্লেখপূর্বক ডিসেম্বরে চার শ্রেণির পদের জন্য একক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু করবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য নিয়োগ পরীক্ষার ধাপসমূহ হবে প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ), লিখিত ও মৌখিক (সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকবে)। আর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্ষেত্রে এ ধাপগুলো হবে প্রিলিমিনারি (এমসিকিউ) এবং মোখিক (সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারিক পরীক্ষা থাকবে)।
আবেদন প্রক্রিয়া: প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জন্য একক বিজ্ঞপ্তি চলবে। আবেদনকারীরা ৩০ দিন সময় পাবেন। একজন প্রার্থী শুধু একটিতেই আবেদন করার সুযোগ পাবেন। যেমন, আকাশ একজন চাকরিপ্রত্যাশী। তিনি চার শ্রেণির চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা রাখেন। কিন্তু আবেদনের ক্ষেত্রে তাকে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি থেকে যে কোনো দুটি বেছে নিতে হবে। তবে আবেদনকারীর যোগ্যতা অনুসারে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শূন্যপদের গ্রেডভিত্তিক তালিকা থাকবে। আবেদনকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রেডভিত্তিক তালিকা থেকে পছন্দক্রম অনুসারে সাজাতে পারবেন। চূড়ান্ত নিয়োগে আবেদনকারীর পছন্দক্রম অনুসরণ করা হবে।
আবেদন ফি: আবেদন ফি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদের জন্য ১৫০০ এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদের জন্য ১০০০ টাকা (বি.দ্র.: বছরে একটি আবেদনে অনেক পদের জন্য পরীক্ষা দেওয়া যাবে)।
বাছাই প্রক্রিয়া ও মেধাতালিকাকরণ: প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস প্রদান করা হবে এবং সিলেবাস অনুসরণ করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হবে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষে উত্তর প্রদান করতে হবে এবং কাট মার্কস উল্লেখপূর্বক ফল প্রকাশ করতে হবে। পদসংখ্যা অনুপাতে লিখিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নির্ধারিত হবে। লিখিত পরীক্ষার কোনো পাসমার্ক থাকবে না। পদসংখ্যা অনুপাতে সর্বোচ্চ নম্বরধারীরা মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিবেচিত হবেন। মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বরসহ পূর্ণাঙ্গ মেধাতালিকা প্রকাশ করতে হবে।
নিয়োগ বোর্ডের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো: বিসিএস সব ক্যাডার ও নন-ক্যাডার, সব প্রফেশনাল ও টেকনিক্যাল পদ (ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ইত্যাদি), পেট্রোবাংলার অধীন প্রতিষ্ঠান, সব সরকারি ব্যাংক (বিবি ও বিএসসিএসের অধীন), প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক, এনটিআরসি, বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ বিতরণ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য সব সরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বোর্ডের অধীনে থাকবে। সরাসরি নিয়োগে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির নবম-২০তম গ্রেডের বিভিন্ন পদের জন্য নিয়োগ বোর্ড বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্রেডভিত্তিক নিয়োগের জন্য সুপারিশ করবে।
বিশেষ কিছু শর্ত: একই প্রার্থী যে কোনো একটি শ্রেণির পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে প্রতিষ্ঠানের তালিকা থেকে পছন্দক্রম সাজাতে পারবেন।
আবেদনকারীর সংখ্যা এক লাখের ওপর হলে বিভাগীয় শহরে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অন্যথায় শুধু ঢাকায় পরীক্ষা হবে।
সব শ্রেণির পদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নিয়োগ শেষে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী সব সুযোগ-সুবিধা লাভ করবেন।
কোনো প্রার্থী কোনো পদে যোগদানের পর একই গ্রেডের পদের বিপরীতে পুনরায় আবেদন করতে পারবেন না। তবে ওপরের গ্রেডে আবেদন করতে পারবেন।
মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক নম্বর রাখতে হবে (কমও না, বেশিও না)।
সুবিধাসমূহ:
কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ থাকলে আবেদনকারীদের শ্রম ও সময় সাশ্রয় হবে।
যে কোনো একটি শ্রেণির পদের জন্য আবেদন করার সুযোগ থাকায় আবেদনকারীর সংখ্যা কম হবে।
একই গ্রেডের বিভিন্ন পদের জন্য বারবার আবেদন করা লাগবে না। ফলে আবেদন ফি সাশ্রয় হবে।
তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির পরীক্ষায় প্রিলিমিনারি শেষে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ায় দ্রুত ফল প্রকাশ ও চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।
নম্বরসহ মেধাক্রম প্রকাশ করতে পারলে তা চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও নিয়োগ সম্পন্ন করতে পারলে চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে নিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা ফিরে আসবে।
প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার আলাদা পরীক্ষা কমিটি/প্যানেল থাকলে দুর্নীতির হার কমে যাবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া যত দ্রুত সম্পন্ন হবে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম তত গতিশীলতা লাভ করবে। তাই নিয়োগ বোর্ডে পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবল নিয়োগ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানে দ্রুততার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আশা করা যায় যে, নিয়োগ বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় প্রস্তাবিত নিয়োগ ব্যবস্থার আলোকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেলে দ্রুততর সময়ের মধ্যে অধিকসংখ্যক লোকবল নিয়োগ প্রদান করা সম্ভব।
লেখক: ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশী