চাষের মাছ যেমন রুই, কাতল পোনা কেনা থেকে শুরু করে রক্ষণাবেক্ষণ, খাবার, যাবতীয় খরচাদির পর অবস্থাভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২০০-৪০০ টাকা। অথচ ইলিশ মাছ! যা কি না শুধু জেলেদের ধরা থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছানোর বাইরে কোনো খরচ নেই, সেই মাছের দাম প্রতি কেজি ১৫০০-১৮০০ টাকা; ভাবা যায়! ইলিশের দাম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি ভাইরাল সংবাদ। ভাইরাল আর একটা সংবাদ, ইলিশ ঘাস খায় না, খড় খায় না, খৈল-ভুসি বা ফিডও খায় না, ইলিশের জন্য চিকিৎসা খরচও নেই, ইলিশ পালতে দিনমজুরও রাখা লাগে না, তারপর দাম এত বেশি কেন?
দামের ঊর্ধ্বগতি আর ইলিশ নিয়ে মাতামাতি দুটোই এখন তুমুল আলোচনায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতে ইলিশ রপ্তানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষ ইলিশ খাবে তারপর রপ্তানির বিষয়ে বিবেচনার বিষয়ে ফরিদা আখতারের বক্তব্য অনেকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে গত ২৫ সেপ্টেম্বর ২ হাজার ৪২০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারপর থেকে নেটিজেনরা ইলিশ রপ্তানি পক্ষে-বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করতে থাকেন। কেউ বলছেন, ইলিশ একটি রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলেছেন, এটি একটি কূটনৈতিক মাছ। কারণ গত কয়েক বছর ধরেই মাছটি নিয়ে চলছে হরেক রকম রাজনীতি ও কূটনীতি। বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যে, বিখ্যাত সাময়িকী ‘ইকোনমিস্ট’ তাদের গত ১৪ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘ইলিশ এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক’ নিয়ে মূল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আসলে, সুস্বাদু ইলিশ পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। জিআই সনদ প্রাপ্তিতে নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্ববাজারে ইলিশ এখন সমাদৃত। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ ইলিশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশেই। এরপর ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন একদল বিজ্ঞানী। পুকুরে ইলিশ চাষ করা যায় কি না, টিনজাত করে ইলিশ বিক্রি করা যায় কি না—এরকম গবেষণাও হয়েছে। তারপরও দিন দিন সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মাছটি। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দুটি ভাইরাল সংবাদ দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। আমি একজন কৃষিবিদ হিসেবে মনে করি, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া এ ইলিশের আকাশচুম্বী দাম হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে দাম বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে মনে করছি, ইলিশের বাজারজাতে তদারকি সংস্থার দুর্বলতার কারণে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ ছাড়া নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন-দূষণ, ডুবোচর ও বাঁধ-সেতুসহ নানা অবকাঠামোর প্রভাবে নদীতে ইলিশের বিচরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাতে মাছটির প্রজনন হুমকির মুখে পড়ছে, ভাটা পড়ছে উৎপাদন। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের মূল্যের প্রভাব তো রয়েছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দিন দিন ইলিশের দাম বাড়ছে।
মৎস্য অধিদপ্তর অবশ্য প্রতি বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে তাদের পরিসংখ্যানে উল্লেখ করে। ২০০২-০৩ সালেও যেখানে বছরে ইলিশ ধরা পড়ত দুই লাখ টনের কম, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ৭১ হাজার টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার টন। এক যুগে ইলিশ আহরণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ সময়ে জনসংখ্যা কি দ্বিগুণ হয়েছে? না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১৩ কোটি ৪১ লাখ। ২০২৩ সালে ১৭ কোটি ২৯ লাখ। জনসংখ্যা ও ইলিশের উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করলে মাথাপিছু ইলিশের সরবরাহ বাড়ার কথা? প্রশ্নটা এজন্য করলাম, আমাদের গ্রামে প্রতি শুক্র ও সোমবার হাট বসত। বর্ষা মৌসুমে ইলিশ হাটে দেখতে পেতাম। তখনো এটার দাম বেশি ছিল। তবে গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্তরাও মাঝেমধ্যে এ সুস্বাদু মাছটি নিয়ে ঘরে ফিরতে পারতেন। সে দৃশ্য এখন কমে গেছে। মনে হয় ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ, আয় ও সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি ও কিছু মানুষের হাতে অসদুপায়ে অর্জিত টাকার ছড়াছড়িতে ইলিশ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের কাছে আরও অধরা হয়েছে। বর্তমানে ভারতে ইলিশ রপ্তানি অজুহাত দিয়ে দাম বৃদ্ধি কথা বলে উসকে দিচ্ছে কেউ কেউ। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট উৎপাদনের মাত্র শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা যথার্থই বলেছেন, ‘যে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে, তা চাঁদপুর ঘাটের একদিনের সমপরিমাণও নয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, তাতে কি দেশি ভোক্তাদের ইলিশ মাছ প্রাপ্তিতে বা বাজারমূল্যে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে গেল?
কথা হয় এই পেশায় জড়িত জেলে, ট্রলারমালিক, আড়তদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। মৌসুমের শুরুতে জাল, ট্রলার মেরামত ও অন্যান্য খরচ মেটাতে ট্রলার মালিকদের ৩-৪ লাখ টাকা খরচ হয়। ট্রলারমালিক অনেক সময় আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নেন। এই দাদনের বদলে অর্থ না দিয়ে মাছ দিতে হয়। যেসব ট্রলারমালিক দাদন নেন, তারা আর কোনোদিনই জাল ছিঁড়ে বের হতে পারেন না। সমুদ্রগামী একটি ট্রলারকে সাগরে ১০ দিনের জন্য ১৬ জন জেলের যাত্রা করতে জ্বালানি, বরফ, বাজার-সদাইসহ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। আবার কখনো আরও বেশি। জেলে হারুনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, মাছ ধরা পড়ে যা লাভ হয়, তার অর্ধেক নেন ট্রলারমালিক। এরপর যা থাকে তা ২০ ভাগ করা হয়। এই ২০ ভাগের মধ্যে ১৬ জন জেলের এক ভাগ করে ১৬ ভাগ, মাঝির ২ ভাগ এবং বাবুর্চি ও ইঞ্জিনচালকের ১ ভাগ। আবার জেলেরা যদি পর্যাপ্ত ইলিশ না পান, তাহলে মোটা অঙ্কের লোকসান গুনতে হয় ট্রলারমালিকের। ফলে কোনো ট্রলারমালিক যদি অনেক ইলিশ পেয়েও যান, তিনি আগের লোকসান পুষিয়ে নিতে চান। ট্রলারের মাঝি রফিক মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, সাগরে আগের মতো মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ১০ বার জাল ফেললেও মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে। আর বৈরী আবহাওয়া তো আছেই।
দেশের বাজারে এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ১৮০০-২০০০ টাকায় বিক্রি হলেও ভারতে রপ্তানি হচ্ছে ১২০০ টাকায়। এটি কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে দেশজুড়ে চলছে সমালোচনা। অবশ্য একটি ব্যবসায়ী সূত্র বলেছে, প্রকৃতপক্ষে ওই দরে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে না। তারা বেশি দামেই এ মাছ ভারতে পাঠাচ্ছেন, খাতা-কলমে দেখানো হচ্ছে ১০ ডলার বা ১২০০ টাকা। আর সরকারি মূল্যের অতিরিক্ত টাকার লেনদেন চলছে হুন্ডিতে।
তাই সবার আগে দরকার দাম কমানোর জন্য চোরাচালান রোধ করা। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া। চাঁদাবাজি বন্ধ করা। তা ছাড়া, জেলেদের যাবতীয় খরচ যেমন ডিজেলের দাম, জালের দাম, সুতা এবং রশির দাম কমাতে হবে। ইলিশের এক-একটি ঘাট থেকেই মোবাইলের মাধ্যমে পুরো দেশে এর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রশাসন যদি সত্যিকার অর্থে ঘাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং জেলের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে, তবে ইলিশের দাম নাগালের মধ্যে আসবে। ইলিশ নিয়ে নিত্য গবেষণা চলছে। কিন্তু কী করলে ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আনা যাবে, সেই গবেষণাটা বেশি দরকার। অবশ্যই বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
লেখক: কৃষিবিদ। উপপরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়