বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘সোনারতরী’ কাব্যের ‘বৈষ্ণব কবিতা’ শীর্ষক কবিতায় বলেছেন,
দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনেÑ প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
তাই দিই দেবতারে; আর পাব কোথা।
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওই বক্তব্য বাঙালি চরিত্রের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রতি আলোকপাত করেছে। বাঙালি দেবতাকে প্রিয় করে তোলে, যেমন দেবী দুর্গা যেন নিজের কন্যা। আবার প্রিয়কে দেবতা করে তোলা; যেমন, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবতুল্য।
দেবী দুর্গা শক্তির দেবী। মহিষাসুর ও তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ অসুররূপী অন্যায়কে তিনি দমন ও বধ করেছেন। দেবী অম্বিকারূপে তিনি বধ করেছেন অত্যাচারী শাসক শুম্ভ ও নিশুম্ভকে। প্রকাশ করেছেন দৈবশক্তি। দুষ্টের দমনের জন্যই তার আবির্ভাব।
আবার তিনি যেন মাতা-পিতার কাছে আদরের কন্যা। দুর্গার অনেক নাম। মায়ের কাছে আদরের নাম উমা। পর্বতরাজদুহিতা বলে তার নাম পার্বতী। দুর্গা ভালোবেসে বিয়ে করেছেন শিবকে। শিব থাকেন কৈলাসে। মহাযোগী তিনি। রাজার দুহিতা স্বেচ্ছায় যোগিনী হলেন। মা মেনকা মেয়ের জন্য দুঃখ ও চিন্তায় অস্থির। যে রাজকন্যা রাজপ্রাসাদের কক্ষে কক্ষে বিচরণ করতেন, আজ তিনি শ্মশানবাসিনী। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েন মা মেনকা। স্বপ্নে দেখেন, মেয়ে এসেছে। পর দিন পর্বতরাজকে বলেন:
‘গিরি, গৌরী আমার এসেছিল,
স্বপ্নে দেখা দিয়ে, চৈতন্য করিয়ে,
চৈতন্যরূপিণী কোথায় লুকাল।’
আকুল হয়েÑ
‘বারে বারে কহে রানী, গৌরী আনিবারে।
জানতো জামাতার রীত অশেষ প্রকারে।।’
স্বামীগৃহে উমার কষ্টের কথা চিন্তা করে মা মেনকা মনে মনে বলেন:
‘এবার আমার উমা এলে,
আর তাকে পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।
আমি শুনেছি নারদের মুখে
উমা আমার থাকে দুঃখে।
শিব শ্মশানে শ্মশানে ঘোরে
ঘরের ভাবনা ভাবে না।’
মেনকার অনুরোধে পর্বতরাজ কৈলাস পর্বতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন গৌরীকে নিয়ে আসবেন। গৌরীর সঙ্গে দেখা করে বললেন:
‘চল মা গৌরী, গিরিপুরী শূন্যাগার,
মা হলে জানিতে উমা, মমতা পিতামাতার।
তব মুখামৃত বিনে আছে রানী ধরাসনে,
অবিলম্বে চল অম্বে, বিলম্ব সহে না আর।’
বাবাকে পেয়ে উমা আনন্দিত। উৎসাহী হয়ে উঠলেন বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য। অনুমতি চাইলেন স্বামী শিবের কাছে:
‘হর, কর অনুমতি, যাই হিমালয়ে,
জনক-জননী বিনে বিদীর্ণ হৃদয়!
এ জ্বালা কি জানে অন্যে আমি মা’র একা কন্যে
গিয়ে তিনদিন জন্যে রব পিত্রালয়ে।’
শিব শর্তসাপেক্ষে উমাকে অনুমতি দিলেন। শর্তটি হলো:
‘জনক ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার।
আমি তব সঙ্গে যাব, কেন ভাব আর।
আহা আহা মরি মরি
বদন বিরস করি
প্রাণাধিকে প্রাণেশ্বরী, কেঁদো নাকো আর।
প্রাণপ্রিয়ে যাবে যথা
সঙ্গে সঙ্গে যাব তথা
ক্ষণমাত্র সঙ্গছাড়া হব না তোমার।
পর্বতরাজ হিমালয় কন্যা উমাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন রাজধানীতে। পত্নী মেনকাকে বললেন:
গিরিরানী এই নাও তোমার উমারে।
ধর ধর হরের জীবন ধন।
কত না মিনতি করি
তুষিয়ে ত্রিশূলধারী
প্রাণ উমা আনিলাম নিজপুরে।’
উমা এসেছেন। মা মেনকার আনন্দ আর ধরে না। তিনি সানন্দে প্রায় দৌড়ে গেলেন উমাকে বরণ করে ঘরে তোলার জন্য। উমা তখন একটু মজা করার জন্যই হয়তো দশভুজা হলেন—হলেন রণরঙ্গিণী। মেনকা একটু ভয়ই পেলেন। তখন কৌতুকিনী দুর্গা দ্বিভুজা উমা হয়ে, ঘরের মেয়ে হয়ে দাঁড়ালেন মেনকার সামনে। আনন্দে অশ্রুসিক্ত হলেন মেনকা। স্বামী গিরিরাজকে ডেকে বললেন:
গিরি, আমার গৌরী এসে এসেছে,
রূপে ভুবন আলো হয়েছে।
মায়ের রূপের ছটা সৌদামিনী
দিন-যামিনী সমান করেছে।
এতদিন পরে উমা এসেছে। তাই তাকে দেখতে এসেছেন আবালবৃদ্ধবনিতা। গুরুজনরা শোনাচ্ছেন আশীর্বাণী। শতমুখে প্রশংসা করছেন মা উমার। ছোটরাও উচ্ছ্বসিত।
আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়েছে রাজপ্রাসাদ। স্বামীর বাড়ির ধরাবাঁধা গৃহকর্ম নেই। কেবল অবসর ও কেবল আনন্দ। সমগ্র পরিবেশ আনন্দে মুখরিত। আনন্দ-হুল্লোড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন উমা। তাই রাতে নিশ্চিন্তে সহজেই নিদ্রামগ্ন হলেন।
ভোর হলো। কিন্তু জাগ্রত হচ্ছেন না দুর্গা। খিদেও তো পেয়েছে। মা মেনকা তাই দুর্গাকে ডেকে তুলছেন:
ওঠ মা সর্বমঙ্গলে প্রভাত হলো যামিনী।
পথশ্রান্তে কত নিদ্রা যাও বিধূবদনী।।
কর্পূরবাসিত বারি
মুখ প্রক্ষালন করি
খাও কিছু প্রাণকুমারী করি আয়োজন।।’
উদাসীন স্বামী। অভাবের সংসার। সেই সংসারে দুর্গার কতই না দুর্গতি! এ দুর্গার সকল কথা ভেবে মা মেনকা মেয়েকে একান্তে জিজ্ঞেস করেন:
‘মা, অমন উদাসীন স্বামীর ঘরে অভাবের সংসারে কেমন করে ছিলি রে, মা!’
মা দুর্গা বলেন, ‘স্বামীটি আমার পাগলাটে বটে। ভুলো মন। সবকিছু ভুলে বসে থাকে। তবে আমাকে খুব ভালোবাসে। কেবল তোমার উমা-অন্তপ্রাণ। খাওয়া-দাওয়াতেও মন নেই। অনেক সময় আমাকে নিজের হাতে মুখে খাবার তুলে দিতে হয়।
স্বামীর কথা উঠতেই মনে পড়ে গেল দুর্গার। তিন দিন পর চার দিনের দিন ফিরে যেতে হবে স্বামীর ঘরে।
তবু মায়ের প্রাণ। তিনি বারবার বলতে থাকেন, ‘মা উমা, এসেছিস যখন, তখন দিনকতক থাক। কিন্তু শিব যে দুর্গাকে ভালোবাসেন এবং দুর্গাও শিবকে। তাই দুজনে দুজনকে ছাড়া থাকতে পারেন না। তবে আসল কারণ আরও গভীরে। কৈলাসে উমা মহেশ্বর দেবস্বরূপে অবস্থান করেন। তখন পার্থিব জগতের কথা তাদের মনে থাকে না। সেখানে দেব-দেবীরূপে তাদের অবস্থান। এ এক গূঢ় তত্ত্ব। তখন দুর্গা জগজ্জননী। ঘরের মেয়ে হয়ে ঘরের মায়ায় আবদ্ধ নন। মাকে সে-কথা বলেন না দুর্গা। উদাসীন ভোলাভালা দরিদ্র এক স্বামীর স্ত্রী—লৌকিক জগতে এই হোক তার পরিচয়। রাজার মেয়ে গরিবের বউ। মেনকাও আমাদের সমাজের মায়ের মতো মেয়ের দুঃখে দুঃখী। তাই তিনি ক্ষোভে-দুঃখে দুর্গাকে বলেন:
তোকে আর অমন স্বামীর ঘরে দুঃখের সংসারে পাঠাব না।
কিন্তু তা কি হয়? বিবাহিত মেয়েকে যে স্বামীর ঘরে পাঠাতেই হয়! তাই তিন দিন থাকার পর চতুর্থ দিনে অর্থাৎ আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথির পরের দিন দশমী তিথিতে তাকে স্বামীর ঘরে পাঠাতে হয়।
বিদায় বেলায় মা ও মেয়ের সে কী কান্না! ওদিকে শিব অপেক্ষা করছেন। দুর্গাকে নিয়ে যাবেন বলে। অবশেষে কেঁদে ও কাঁদিয়ে মা দুর্গা চলে গেলেন স্বামীর ঘরে কৈলাস পর্বতে।
সজল চোখে মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে মা মেনকা মেয়েকে বলেন, ‘আসছে বছর আবার আসিস মা। মাকে ভুলিস না। আবার যেন তোর মুখে মা ডাক শুনতে পাই।’
ভক্তরাও তিন দিন পূজার পর দশমীর দিন দেবী-প্রতিমার বিসর্জন দেন। মা দুর্গাকে চোখের জলে বিদায় দেন। ঠিক একইভাবে নাইওরে আগত বিবাহিত কন্যারাও শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বিদায় নেয়। এভাবেই একাকার হয়ে যান দেবী দুর্গা আর ঘরের মেয়ে। বলা যায়, দেবী দুর্গাও হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘দেবতারে প্রিয় করি’।
এ শুধু পুতুলপূজা নয়। তাই তো স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, হিন্দুরা খড়মাটি দিয়ে গড়া পুতুলপূজা করে না। তারা ‘মৃন্ময়ী মাঝে চিন্ময়ী হেরি হয়ে যায় আত্মহারা’। তখন আর মেয়েতে-দেবীতে কোনো পার্থক্য থাকে না। দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে—যার সঙ্গে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনার সম্পর্ক।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অনারারি প্রফেসর ও বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রাক্তন খণ্ডকালীন ফ্যাকাল্টি